সারাদেশে ২ হাজার ৫৪১ রেলক্রসিঙের মধ্যে ১ হাজার ১২৮টি অবৈধ : গেটম্যান নেই ২ হাজার ১৬০ টিতে

 

রেলক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ : ৫ বছরে ৬৫ দুর্ঘটনায় নিহত ২শ ৯২

স্টাফ রিপোর্টার: দেশের রেলক্রসিংগুলো রীতিমতো মৃত্যুফাঁদ হয়েই দাঁড়িয়েছে। অরক্ষিত অসংখ্য রেলক্রসিঙে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলছে, কোনোভাবেই তা থামানো যাচ্ছে না। দেশজুড়ে এমন অরক্ষিত রেলক্রসিঙের সামনে-পেছনে সাইনবোর্ড টানিয়েই দায়িত্ব শেষ করে রেল কর্তৃপক্ষ।‘সাবধান! এ গেটটি অননুমোদিত, এখানে কোনো গেটম্যান নেই। পথচারী ও সব ধরনের যানবাহনের চালক নিজ দায়িত্বে পারাপার হবেন এবং যে কোনোরূপ দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে নিজেই বাধ্য থাকিবেন’-রেল কর্তৃপক্ষের লেখা এমন সাইনবোর্ড থাকলেও তা দুর্ঘটনা রোধে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখছে না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেসব ক্রসিং পারাপারের সময় প্রায়ই মানুষজন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। প্রতিবছর শত শত দুর্ঘটনা ঘটলেও তা প্রতিরোধে যথাযথ কার্যক্রম নেওয়া হয় না।

অরক্ষিত রেলক্রসিংগুলো নিয়মিত পরিদর্শনের নিয়ম থাকলেও এক্ষেত্রে রয়েছে গড়িমসি। রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সারাদেশে বৈধ-অবৈধ যেসব লেভেল ক্রসিং রয়েছে, এর বেশির ভাগই সড়ক ও জনপথের। এছাড়া এলজিইডি, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংস্থা-প্রতিষ্ঠানের বিপুলসংখ্যক বৈধ-অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই এসব লেভেল ক্রসিং গড়ে তোলা হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে জনবহুল ঢাকা মহানগরীর ব্যস্ত সড়কের ক্রসিংগুলো। টঙ্গী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ৪১টি ক্রসিঙে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। এর মধ্যে আটটি রেলক্রসিংকে সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা দিয়েছিলো ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। এসব ক্রসিঙে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করেন। নগরীতে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে যে আটটি রেলক্রসিং চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হলো মগবাজার, মালিবাগ, তেজগাঁও, সায়েদাবাদ, এফডিসি, বনানী, জুরাইন ও খিলগাঁও। আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে দুর্ঘটনা রোধে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মহাসড়ক রেলক্রসিঙের পরিবর্তে গ্রেড সেপারেশন (ফ্লাইওভার, ওভারপাস, আন্ডারপাস) নির্মাণ, অননুমোদিত রেলক্রসিং বন্ধ করা, প্রয়োজনীয় স্থানে অনুমোদিত ক্রসিঙের ব্যবস্থা নেয়া, ভবিষ্যতে রেলের অনুমতি ছাড়া রেলক্রসিং নির্মাণ রোধ করাসহ নানারকম সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এছাড়াও প্রয়োজনীয় গার্ড নিয়োগ, টেলিযোগাযোগসহ উন্নত সিগন্যাল ব্যবস্থা চালুকরণ এবং লেভেল ক্রসিংগুলোর মানোন্নয়নে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ১১১ কোটি টাকার পৃথক দুটি প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু গত দু বছরে এ বিষয়ে কোনোরকম সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটিগুলো দুর্ঘটনা রোধে যেসব সুপারিশ করে সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগ দেখতে পাওয়া যায় না। দুর্ঘটনা রোধে প্রস্তাবিত প্রকল্প ও সুপারিশমালা সবকিছুই বছরের পর বছর ধরে ফাইলচাপা পড়ে থাকে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

শুধু রেলক্রসিংই অরক্ষিত নয়, রেললাইনের ওপর গড়ে উঠেছে অবৈধ মার্কেট, হাটবাজার, বড় বড় বস্তি। রাজধানীর সায়েদাবাদের অদূরে এবং মহাখালী থেকে বনানী পর্যন্ত এলাকায় রেললাইনের ভেতরে সুড়ঙ্গ কেটে ঘর বানিয়ে বসবাস করছেন মানুষ। ফলে রেললাইন চরম বিপন্ন দশায় পড়েছে। রেললাইন ও ক্রসিং ঘিরে নানা দখলবাজির বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে রেল কর্তৃপক্ষ অভিযান চালালেও তা আইওয়াশ হিসেবেই গণ্য হয়ে থাকে।

রেলক্রসিং পার হতে গিয়ে প্রায়ই বাস-ট্রেন মুখোমুখি সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে ৬৫ ট্রেন দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ২৯২ জন যাত্রীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আহত হয়েছেন আরও ১২ শতাধিক যাত্রী। সর্বশেষ গতকাল ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার রেলক্রসিঙে ট্রেনের সাথে বরযাত্রীবাহী বাসের সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১১ জন। এছাড়া আহত হয়েছেন ৬০ জন।

রেল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, বিগত ২০১৩ সালে সারাদেশে রেলওয়ের দু অঞ্চলে ২৫টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫৯ জন। আহত হন ২৮২ জন সাধারণ যাত্রী। ওই বছরে কিছু রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাও ছিলো। ২০১২ সালে ১৪ দুর্ঘটনায় মারা যান ৩৮ যাত্রী। আর আহত হন ২০১ যাত্রী। ২০১১ সালে ১৭ দুর্ঘটনায় মারা যান ৫১ যাত্রী। আহত হন ৩৪১ জন। ২০১০ সালে রেল দুর্ঘটনা ঘটে ৪২টি, এসব ঘটনায় মারা যান ৪৩ ও আহত হন ২৮৩ জন।

এভাবে প্রতিবছর ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণহানির শিকার গড়ে অর্ধ শতাধিক সাধারণ মানুষ। বর্তমানে সারা দেশে ২ হাজার ৫৪১টি রেলক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪১৩টি অনুমোদিত এবং ১ হাজার ১২৮টি অনুমোদনহীন। বর্তমানে ঢাকা লাইনের নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গী পর্যন্ত ৩৫টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে অবৈধ ২১টি এবং বৈধ রেলক্রসিং মাত্র ১৪টি। অনুমোদনহীন ক্রসিঙে কোনো গেটম্যান না থাকায় অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছেই। এছাড়া রেলওয়েতে এখনো শূন্যপদ পূরণ না হওয়ায় এমন সংকট চলছে বলে জানান রেলের মহাপরিচালক মো. তাফাজ্জল হোসেন। তিনি বলেন, শিগগিরই প্রধান প্রধান ক্রসিঙে গেটম্যান নেয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক বলেন, শীঘ্রই অবৈধ রেলক্রসিঙের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া গেটম্যান পদ্ধতি আরও আধুনিক করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

দেশে মোট ২২৮টিতে স্থায়ী ও ১৫৩টিতে অস্থায়ী গেটম্যান রয়েছেন। অনুমোদনহীন গেট নির্মাণ করলেও বাধা দেয়নি রেলওয়ে। গেটের উভয় পাশে ‘গেটম্যান নেই’সতর্কবাণীর সাইনবোর্ড দিয়েই দায়িত্ব সেরেছে রেল কর্তৃপক্ষ। আর গেটম্যানদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে গাফিলতির অভিযোগটি পুরনো। এদিকে গত দু বছরে রাজধানীর তিনটি স্থানের রেলক্রসিঙে ওভারপাস ও ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হওয়ায় কিছু দুর্ঘটনা কমেছে। কুড়িল, বনানী ও মহাখালী এলাকায় ওভারপাস নির্মাণ করায় জনসাধারণের ভোগান্তি কিছু কমেছে। এছাড়া গত বছর ক্রসিঙে গেটের পরিবর্তে গ্রেড সেপারেশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো রেলপথ মন্ত্রণালয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাপরিচালক আরও বলেন, অবৈধ ক্রসিঙে গেটম্যান থাকার সুযোগ নেই। আর ৭৮০টি গেটম্যানের পদের মধ্যে শূন্যপদ রয়েছে ৫৪২টি। অস্থায়ী ভিত্তিতে কিছু গেটম্যান রয়েছে। অস্থায়ী গেটম্যানকে ৩২ দিনে দেয়া হয় ২ হাজার ৩৫০ টাকা। তাই এদের অনেকে হয়তো পাশাপাশি অন্য কাজ করেন।

রেলওয়ের নেটওয়ার্কে রেলক্রসিং গেটের বর্তমান অবস্থা নিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় ৫টি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো। সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মহাসড়ক রেলক্রসিঙের পরিবর্তে গ্রেড সেপারেশন (ফ্লাইওভার, ওভারপাস, আন্ডারপাস) নির্মাণ করতে হবে। অনুমোদনহীন ক্রসিংগুলো অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ রেলকে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের দেয়া, ভবিষ্যতে রেলের অনুমতি ছাড়া রেলক্রসিং নির্মাণ করা যাবে না। অননুমোদিত রেলক্রসিং বন্ধ করা নিয়ে নির্মাণকারী সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও রেলওয়ের যৌথ জরিপ এবং অনুমোদিত ক্রসিংগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক/এলজিইডি/সংস্থার সহায়তা নেয়া হবে।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিগত ২০০৮ সালের ২০ এপ্রিল এক সভায় রাজধানীর রেলক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর বিভিন্ন সংস্থা তা পর্যালোচনা করে। তিনটি উড়াল সড়ক নির্মাণ কাজ শেষ করা হয়। এ ছাড়া আরও কিছু রেলক্রসিঙের ওভারপাস নির্মাণ করার জন্য দরপত্র আহ্বান ও কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এ স্থানগুলো হলো এফডিসি রেলক্রসিং, জুরাইন রেলক্রসিং, তেজগাঁও ক্রসিং, মালিবাগ ও মিরপুর-মাটিকাটা ক্রসিং। এর মধ্যে তিনটি উড়াল সড়ক (মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান, মেয়র হানিফ ও কুড়িল) নির্মাণ কাজ শেষ হলেও মগবাজার এলাকার উড়াল সড়ক কাজ চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এসব এলাকার নির্মাণ কাজ শেষ হলে এখানকার জনবল শূন্যপদের রেলক্রসিঙে বদলি করা হবে।