সাত মন্ত্রী-এমপির সম্পদের তদন্তে দুদক

স্টাফ রিপোর্টার: দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় দেয়া তথ্য অনুযায়ী সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের অস্বাভাবিকভাবে সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিক ধাপে বুধবার সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আফম রুহুল হক, সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান ও সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমানসহ সাতজনের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। অন্য যে চারজনের সম্পদ বৃদ্ধি তদন্তে কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে তারা হলেন- ঢাকা-১৪ আসনের সাবেক এমপি আসলামুল হক, কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি, রাজশাহী-৪ আসনের সাবেক এমপি এনামুল হক এনা ও সাতক্ষীরা-২ আসনের মো. আবদুল জব্বার।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পর্যায়ক্রমে আরও বেশ ক’জন সাবেক মন্ত্রী-এমপির অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়টি অনুসন্ধান করবে দুদক। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় দেয়া তথ্যের সাথে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামার তথ্য অনুযায়ী প্রায় অর্ধশত মন্ত্রী-এমপির অস্বাভাবিক হারে সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেরই সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে শ শ গুন। হলফনামায় দেয়া তথ্য অনুযায়ী সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খানের আয় বেড়েছে একশ গুনেরও বেশি, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমানের ২০ একর সম্পত্তি বৃদ্ধি পেয়ে পাঁচ বছরের ব্যবধানে হয়েছে ২ হাজার ৮৬৫ একর।

এদের মধ্যে আব্দুল জব্বার জাতীয় পার্টির (জাপা)। বাকি তিনজনই আওয়ামী লীগের টিকিটে নবম সংসদে থাকার পর দশম সংসদ নির্বাচনেও বিজয়ী হয়েছেন। দুদকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, আফম রুহুল হকের সম্পদের তদন্ত করবেন দুদক উপপরিচালক মির্জা জাহিদুল। আব্দুল মান্নান খানের সম্পদের তদন্ত করবেন দুদক উপপরিচালক নাসির উদ্দিন। মাহবুবুর রহমানের সম্পদের তদন্ত করবেন দুদক উপপরিচালক খাইরুল হুদা। আসলামুল হকের সম্পদের তদন্ত করবেন দুদক উপপরিচালক শেখ ফাইয়াজ আলম, আব্দুর রহমান বদির সম্পদ অনুসন্ধান করবেন দুদক উপপরিচালক আহসান আলী, এনামুল হকের সম্পদের তদন্ত করবেন উপপরিচালক সৈয়দ তাহসানুল হক এবং এম এ জব্বারের সম্পদ তদন্ত করবেন দুদকের উপসহকারী পরিচালক মাসুদুর রহমান।

আফম রুহুল হক: ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনে দেয়া হলফনামা অনুসারে, রুহুল হক এবং তার স্ত্রীর নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত টাকা ছিলো ৯২ লাখ ৩৬ হাজার ১০৮ টাকা। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে দেয়া হলফনামা অনুসারে তাদের ব্যাংক ব্যালেন্সের পরিমাণ ১০ কোটি ১৫ লাখ ৯৪ হাজার ৭৬৩ টাকা। ২০০৮ সালে তিনি এবং তার স্ত্রীর মোট অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিলো চার কোটি টাকার কিছু বেশি। ২০১৩ সালে তার পরিমাণ ১৬ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

আব্দুল মান্নান খান: হলফনামা অনুসারে পাঁচ বছর আগে আব্দুল মান্নান খানের সাকুল্যে ১০ লাখ ৩৩ হাজার টাকার সম্পত্তি ছিলো। পাঁচ বছরের ব্যবধানে সেটা হয়েছে ১১ কোটি তিন লাখ টাকা।

মাহবুবুর রহমান; হলফনামায় দেয়া তথ্য অনুসারে গত পাঁচ বছরে ২০ একর জমি থেকে ২ হাজার ৮৬৫ একর জমির মালিক হয়েছেন মাহবুবুর রহমান। পাঁচ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ছাড়া কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ না থাকা স্ত্রীর নামে এখন এক কোটি ২৬ লাখ ৭১ হাজার টাকার সম্পদ রয়েছে। নিজের ৩৬ লাখ ৩৩ হাজার ১১২ টাকার স্থাবর সম্পদ পাঁচ বছরের ব্যবধানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ কোটি ২৫ লাখ ৬৬ হাজার ৭২ টাকা।

এনামুল হক: ২০০৮ সালে শুধু বেতন-ভাতা থেকে তার বছরে আয় ছিলো ২০ লাখ টাকা। পাঁচ বছর পরে এখন কৃষি, বাড়ি ও দোকান ভাড়া, ব্যবসা ও পেশা থেকে বছরে তার আয় হয় ৫০ লাখ টাকা। পাঁচ বছর আগে তার স্ত্রীর থাকা ২ কোটি ৮৯ লাখ ৬৩ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ টাকায়।

আবদুর রহমান বদি: হলফনামা অনুসারে সংসদ সদস্য বদির এখন বার্ষিক আয় ৭ কোটি ৩৯ লাখ ৩৯ হাজার ৮০৮ টাকা। আর বার্ষিক ব্যয় ২ কোটি ৮১ লাখ ২৯ হাজার ৯২৮ টাকা। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জমা দেয়া হলফনামা অনুসারে তখন তার বার্ষিক আয় ছিলো ২ লাখ ১০ হাজার ৪৮০ টাকা।

আসলামুল হক: ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের আগে দেয়া হলফনামা অনুসারে, তিনি ও তার স্ত্রী মাকসুদা হক ৪ একর ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ জমির মালিক। এসব জমির দাম দেখিয়েছেন ২০ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ টাকা। আর দশম সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে দেয়া হলফনামায় দেখিয়েছেন, তিনি ও তার স্ত্রী এখন ১৪৫ দশমিক ৬৭ একর (১৪ হাজার ৫৬৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ) জমির মালিক। জমির দাম উল্লেখ করা হয়েছে ১ কোটি ৯২ লাখ ৯৯ হাজার ৫০০ টাকা।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজনের) দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ ও ২০১৩ সালে নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে আয়, সম্পদ, দায়দেনা, আয়কর-সংক্রান্ত তথ্য এবং পারিবারিক ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ৪৮ প্রার্থীর আয় গড়ে ৫৮ ভাগ বেড়েছে। এ হার মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে ২৪৩ ভাগ, প্রতিমন্ত্রীদের ক্ষেত্রে ৪৬৪ ভাগ এবং জাতীয় সংসদের উপনেতা, চিফ হুইপ, হুইপদের ক্ষেত্রে ৩০৭১ শতাংশ পর্যন্ত। সম্পদ বৃদ্ধির এ হার দেখে বিস্মিত দেশের সর্বস্তরের মানুষ। সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। সব মহল থেকে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও ওঠে। এ অবস্থায় দুদক প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বুধবার নবম জাতীয় সংসদের সাত মন্ত্রী ও এমপির অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য সাতজন অনুসন্ধানী কর্মকর্তা নিয়োগ দেন।

দুদক সূত্র জানায়, গত বছরের ডিসেম্বরে বিভিন্ন সংবাদপত্রে মহাজোট সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের অস্বাভাবিক সম্পদ নিয়ে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে সেখান থেকে ৭০টি রিপোর্ট আমলে নিয়ে যাচাই-বাছাই করছে দুদক। এসব প্রতিবেদনে প্রায় ৫০ জনের নাম ছিলো। এদের মধ্য থেকেই দুদক শুরুতে ৭ জনের ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করেছে। এসব মন্ত্রী-এমপির পোষ্যসহ যেসব আত্মীয়স্বজন অগাধ সম্পত্তির মালিক বনে গেছেন তাদের সম্পদেরও অনুসন্ধান করা হবে।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, সাতজনের অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জনের বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য সাতজন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কমিশন বুধবার এ নিয়োগ দেন। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা আইনের বিধিবিধান অনুযায়ী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করবেন।

দুদক সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কিছু ব্যক্তির অনিয়মের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে দুদক কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনিয়মের তথ্য দুদককে দেয়া হয়েছে। তবে দুদকের এ প্রাথমিক পদক্ষেপের সফলতা নিয়ে শঙ্কিত অনেকেই। কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করছেন, রেলের নিয়োগ-বাণিজ্যে তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, পদ্মা সেতু ষড়যন্ত্রে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে আওয়ামী লীগ নেতা ডা. এইচবিএম ইকবাল, ২০০১ সালে আদমশুমারি ও গৃহ গণনা প্রকল্পের প্রশ্নপত্র মুদ্রণ অনিয়মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীসহ সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও দলীয় নেতা জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী, সাইমুম সরোয়ার কমল, বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারিতে দু এমপিপুত্রের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আলোচনা থাকলেও কোনোটাই প্রমাণ করতে পারেনি দুদক। তবে হতাশার মাঝেও আশার আলো দেখতে চান দেশের সাধারণ মানুষ। দুর্নীতিবাজদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর পাশাপাশি একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে সব মহলের সচতেনতা ও কার্যকর ভূমিকা দেখতে চান তারা।

দুদক চেয়ারম্যানের বক্তব্য: বুধবার সন্ধ্যায় দুদক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক পরিচয় যাই থাকুক না কেন, যার বিরুদ্ধেই অভিযোগ প্রমাণিত হবে তার বিরুদ্ধেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।