সর্বনাশা মাদকের গ্রাসে সর্বহারা চুয়াডাঙ্গার আকন্দবাড়িয়া আবাসনের অধিকাংশ পরিবার

মাদকচক্রের হোতাদের মাদক ছড়ানোর হাতিয়ার হতদরিদ্র নারী-পুরুষ

 

নজরুল ইসলাম: চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের আকন্দবাড়িয়া আবাসনটি এখন অন্যনামে পরিচিতি পেয়েছে। এ আবাসনের বাসিন্দাদের অধিকাংশকেই মাদকপাচারকারী চক্রের হোতারা কাজে লাগিয়ে জড়িয়ে দিয়েছে মামলায়। এ আবসনে প্রতিদিন অসংখ্য যুবক মোটরসাইকেলযোগে আসা যাওয়া করে। উদ্দেশ্য একটাই, তা হলো মাদক সেবন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভূমিহীন ও আশ্রয়হীন মানুষের আশ্রয় দিতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ২০০৬ সালে রজনীগন্ধা নামে ১৫০টি ঘর এবং ২০১১ সালে ডালিয়া গুচ্ছগ্রাম ও পারিজা গুচ্ছগ্রাম নামে ৮০টি টিনশেডের ঘর নির্মাণ করা হয় এক একটি পরিবারের জন্য। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের খাস জমিতে নির্মিত এসব ঘরে বিভিন্ন জায়গার ২৩০টি ভূমিহীন পরিবার আশ্রয় নেয়। শুরুটা ভালোই ছিলো। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন হতদরিদ্র মানুষগুলোকে স্বাবলম্বী করে তুলতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। স্বল্প মেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি এমনকি সুদমুক্ত নগদ অর্থ, গরু-ছাগল এবং সেলাইমেশিনসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিতে থাকে। শেষমেশ সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। আবাসনের কর্তৃত্ব আর নেতৃত্বে হাত বদলের কারণে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যায় বিফলে। আকন্দবাড়িয়া, রাঙ্গিয়ারপোতা, মনোহরপুর, উথলী, সিংনগর, রতিরামপুরসহ আশাপাশের গ্রামের মাদক গডফাদারদের নজর পড়ে আবাসনের হতদরিদ্র মানুষগুলোর ওপর। অভাব-অনটনের সংসার চালাতে চোরাচালানিদের প্রলোভনে পড়ে যায় আবাসনের অনেক নারী-পুরুষ। এদের মধ্যে রয়েছে কৃষ্ণা, হামিদা, ফাতেমা, সুফিয়া, রিতা, রুশিয়া, পলি, ইসমাতারা, শিল্পী, সুরভী, রোজিনা, ঈশ্বরদির আমির হোসেন, হামিদ, ফিরোজা, মুসলিমা, রুবেল, লাল্টু, জাকির, তারিফসহ অনেকেই। পাবনা ঈশ্বরদীর আমির হোসেনের রয়েছে একাধিক স্ত্রী। অভিযোগ রয়েছে আমির হোসেন তার স্ত্রীদের ব্যবহার করেন ফেনসিডিল পাচারের কাজ।

ধরাপরা এসব মানুষের মাথায় রয়েছে একাধিক মামলা। শুধু আকন্দবাড়িয়া আবাসনেই না আকন্দবাড়িয়া ও রাঙ্গিয়ারপোতা গ্রামে ১৫ জনের মত রয়েছে মাদকসম্রাট। তারা একাধারে মাদকের ব্যবসা ও মামলা জড়ানোর কারণে এলকাবাসী তাদের মাদকসম্রাট বা সম্রাঙ্গী নাম দিয়েছে। যারা এ দু গ্রামের প্রায় দু শতাধিক খুচরা মাদক বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণ করে। এদেরকে কখনও জনহাজিরায় সীমান্তের কাঁটাতারে পাঠায়। আবার কখনও কয়েক ডজন ফেনসিডিল দেশের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দিতে ব্যবহার করে। এসব মাদকসম্রাট-সম্রাঙ্গীরা হতদরিদ্র এ সব মানুষগুলোকে কামলা হাজিরায় মাদকদ্রব্য বহন করাতে গিয়ে মাঝে মাঝে আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের হাতে কেউ কেউ ধরা পড়ে। বিশেষ করে নারী ও শিশু-কিশোরদেরকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে এ কাজে। দরিদ্র মানুষগুলো জেল-জরিমানার ঘানি টানলেও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় গডফাদাররা। প্রশাসনের হাতে ধরা পড়লে তাদের আর খোঁজ রাখে না কেউ। মামলা চালাতে গিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যরাও নতুন করে জড়িয়ে পড়ে মাদকব্যবসায়। এভাবেই পরিবারের উপার্জনক্ষম লোকটি একদিন সর্বস্ব খুইয়ে আবাসন ছেড়ে হয়ে পড়ে নিরুদ্দেশ। বাড়িতে ফেলে রেখে যাওয়া পরিবারের অন্য সদস্যরা কোনো উপায়ান্ত না পেয়ে একদিন তারাও ছাড়ে আবাসন। এ আবাসনে শুধুমাত্র ইউনিয়নের ভূমিহীন মানুষের বসবাসের জন্য নির্মাণ করা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কেবল মাদকের ব্যবসার জন্য আবাসনে আশ্রয় নেয় অনেকে। আবাসনে প্রথম দিকে আশ্রয় নেয়া মানুষগুলোর মধ্যে বর্তমানে ১০/১৫ জন বসবাস করলেও অধিকাংশই আর নেই। স্থানীয় লোকজনের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে প্রতি মাসেই নতুন নতুন মুখ হাজির হয় আবাসনে। সরেজমিনে দেখা যায়, আবাসনের বেশিরভাগ ঘর থাকে তালাবদ্ধ। আবার দীর্ঘদিন ব্যবহার না করার ফলে অনেক ঘর বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। জীবন-জীবিকার তাগিদে আবাসনের লোকজন ফেনসিডিল পাচারের সাথে জড়িয়ে শুধু নিজেকেই ধ্বংস করেনি, ধ্বংস করেছে সমাজ ও নিজ পরিবারকে। প্রতিদিন সকাল থেকে জেলাসহ ঝিনাইদহ জেলার মাদক সেবনকারীরা একটি মোটরসাইকেলে ২/৩ জন করে আসে। এলাকায় ঢোকার আগে মোবাইলে যোগাযোগের মাধ্যমে দামদর ঠিক করে নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে খুচরা মাদক বিক্রেতারা। চোখের ইশারায় ছদ্মনাম দেয়া ফেনসি/ডাল/ফান্টা/ ফান্টু/ ইঞ্চি/ মধু/ লাইন/ মবিল/ মাল ইত্যাদি বেচা বিক্রি আর খাওয়া হয়ে যায় নিমিশেই। কারণ ফেনসিডিল একটি তরল পদার্থ। আর এসব কিছুই সাপ্তাহিক ও মাসিক চাঁদার বিনিময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখেও না দেখার ভান করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। মূলত এ আবাসনে বেশির ভাগই বিক্রি হয় ফেনসিডিল। এর প্রধান যোগানদাতা গেদে সীমান্তের বিন্দা নামে এক ব্যক্তি। অন্যান্য মাদকদ্রব্যের মধ্যে ফেনসিডিল নামক ওষুধ জাতীয় দ্রব্যটির ব্যবহার এখন সবার শীর্ষে। অথচ এ ফেনসিডিল এক সময় আমাদের দেশসহ আশপাশের দেশগুলোতে ব্যবহৃত হতো জীবন রক্ষার তাগিদে। তখন কেউ জানত না যে এটি মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর। আজ থেকে প্রায় ২৫-৩০ বছর পূর্বে এই ফেনসিডিল ছিলো কেবলই একটা সাধারণ কাশির ওষুধ। যা দেশে ফেনসিডিল উৎপাদন বা আমদানির বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান নেই। ফেনসিডিল তৈরি করছে ভারতস্থ রোন-পোলেনক নামক একটি ওষুধ কোম্পানি। তবে এটা কাশির সিরাফ হিসেবে যে ওষুধ ব্যবহার হওয়ার কথা সেটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে নেশার বস্তুরূপে। যদিও ওই ‘রোন-পোলেনক’ (বাংলাদেশ) আমাদের দেশে রয়েছে এবং ব্যান্ড মেডিসিন হিসেবে ওই ফেনসিডিল প্রস্তুত এবং সরবরাহ করে না। ১৯৮৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের এই বাংলাদেশে ‘মে অ্যান্ড বেকার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ফেনসিডিল বাজারজাত করতো। ১৯৮৬ সালে দেশের জাতীয় ওষুধ নীতির আওতায় এটিকে নেশার উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কায় বাংলাদেশ সরকার ফেনসিডিল বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফেনসিডিল তৈরির উপাদান হিসেবে মূলত ৩টি কেমিকেলের নাম আমরা জানতে পারি। এগুলো হচ্ছে কোডিন ফসফেট, প্রমিথিজিন হাইড্রোক্লোরাইড ও ইফিড্রিন হাইড্রোক্লোরাইড। এর মধ্যে কোডিন ফসফেট হচ্ছে মরফিন-প্যাথেডিন গ্রুপের সিনথেটিক ডেরিভেটিভ এবং এটিতেই রয়েছে নেশার উপাদান। কোডিন-ফসপেট হচ্ছে ওপিয়েট বা আফিমের পানযোগ্য রূপ, এটি হোরোইনের চেয়েও ক্ষতিকর।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আবাসনের একজন বৃদ্ধা বললেন, প্রথম থেকেই এখানে আছি। আমার জানামতে এ পর্যন্ত আবাসনের ৩ শতাধিক পরিবার ফেনসিডিল ব্যবসার সাথে জড়িয়ে ধ্বংস হয়েছে। এখনও অনেকেই খাটছেন জেল। আর কেউ জামিনে এসে করছেন ব্যবসা। চলতি বছরের এপ্রিল এবং মে মাসেই ১৫ জন ফেনসিডিলসহ ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী। শুধু আবাসনেই আছে ২৫/৩০টি গাঁজা সেবনের আসর। সন্ধ্যা হলেই স্থানীয় মাদকসেবীরা পরিত্যাক্ত অনেক ঘরে দল বেঁধে বসায় নেশার আড্ডা। প্রতিবাদ করতে গেলে ছাড়তে হয় আশ্রয়টুকুও।