সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু : খালেদা জিয়া হারাচ্ছেন সরকারি সুযোগ-সুবিধা

স্টাফ রিপোর্টার: সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিরোধীদলীয় নেতার পদের পাশাপাশি মন্ত্রীর পদমর্যাদায় পাওয়া সরকারি সুযোগ-সুবিধাও হারাতে যাচ্ছেন। নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়ারই অংশ হিসেবে আজ বুধবার নতুন নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। আজ সকাল ১০টায় সংসদ ভবনে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠিত হবে। এরপর আজ নয়তো আগামীকাল শুক্রবার দলটির সংসদীয় দলের বৈঠকে সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচন করার পর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে তা অবহিত করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে, এরপরই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে পূর্ণাঙ্গ সরকার গঠনের আহ্বান জানাবেন। এবার প্রাথমিকভাবে ৪৫ সদস্যের মন্ত্রিসভা হবে। ১২ থেকে ১৪ জানুয়ারির মধ্যে এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে বলে জানা গেছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীল দুজন কর্মকর্তা গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে এ তথ্য জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে খালেদা জিয়ার জন্য প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধা বাতিল করা হবে। আজ বৃহস্পতিবার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী এমপিদের শপথ অনুষ্ঠিত হবে। এর পরপরই সরকার গঠন হবে। ১৯৯১ সালের পর থেকে খালেদা জিয়া হয় প্রধানমন্ত্রী, না হয় বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করে এ ধরনের সরকারি সুযোগ-সুযোগ পেয়ে আসছিলেন। কিন্তু এবার বিরোধীদলবিহীন একতরফা নির্বাচনে খালেদা জিয়া অংশ না নেয়ায় এ ধরনের সরকারি সুবিধার বাইরে চলে যাচ্ছেন। জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদটি একজন পূর্ণমন্ত্রীর পদমর্যাদার। বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও মন্ত্রীর মতো পান। তাকে ঢাকা মহানগর পুলিশ থেকে একজন হেড কনস্টেবল, একজন নায়েক ও ছয়জন কনস্টেবলসহ মোট আটজন হাউস গার্ড দেয়া হয়। এর বাইরে বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে দুজন গানম্যান পালাক্রমে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। পুলিশ জানিয়েছে, বর্তমানে যেহেতু তিনি বাসার বাইরে বের হচ্ছেন না, তাই পুলিশ প্রটেকশন উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে এসবির গানম্যান রয়েছে। বিরোধীদলীয় নেতা সরকারি একজন একান্ত সচিব (পিএস), একজন সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস), দুজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, একজন বাহক, দুজন এমএলএসএস ও একজন বাবুর্চি পেয়ে আসছিলেন। গাড়ির সুবিধাও পেয়ে থাকেন বিরোধীদলীয় নেতা। তবে খালেদা জিয়া সরকারি বাসায় থাকেন না। বিরোধীদলের প্রধান বেতন পান ৫৩ হাজার ১০০ টাকা। এছাড়াও চিকিত্সা, ভ্রমণসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও সুবিধা পেয়ে থাকেন। বিরোধীদলীয় নেতার পদ হারানোর ফলে খালেদা জিয়া এসব সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।  তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকার চাইলে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে খালেদা জিয়াকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা দিতে পারে।

আওয়ামী লীগ এবং সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা যায়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী এমপিরা শপথ নেবেন আজ। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী নতুন সংসদ সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করাবেন। বুধবার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গেজেট প্রকাশ হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী গেজেট প্রকাশের তিন দিনের মধ্যে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ নেয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবধকতা রয়েছে। তবে সংসদ বহাল রেখে শপথ হলে একটি আসনে একই সময়ে দুজন সংসদ সদস্য থাকার জটিলতা থাকায় সরকারের পক্ষে এর আইনি ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, নতুন সংসদ সদস্যদের শপথের সাথে সাথেই নবম সংসদ ভেঙে যাবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মঙ্গলবারের বৈঠকে নবম সংসদ ভেঙে দেয়া, নতুন সংসদ সদস্যদের শপথ এবং সরকার গঠনের বিষয়ে সার্বিক আলোচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নবনির্বাচিত সদস্যদের জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় তলব করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাতের মধ্যে নবনির্বাচিত সব সদস্য ঢাকায় এসে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। সংসদ সদস্যদের পরপরই মন্ত্রিপরিষদ গঠন এবং তাদের শপথের কার্যক্রম শুরু হবে। জানা যায়, রোববার ১২ জানুয়ারি মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে। ইতোমধ্যে মন্ত্রীদের জন্য ৪৫টি গাড়ি প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৪৫ জনকে মন্ত্রী হিসেবে শপথ দেয়া হবে বলে জানা গেছে। পরবর্তীতে তা আরও বাড়ানো হতে পারে। তবে এবার অনেক নতুন মুখ মন্ত্রী হিসেবে দেখা যাবে বলে জানা গেছে। অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্য থেকে অনেককে মন্ত্রী করা হবে বলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহল থেকে জানা গেছে। আগে যারা মন্ত্রী হননি তাদের মধ্য থেকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হবে। তাছাড়া বিগত সরকারে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তাদের অনেককে বাদ দেয়া হবে।

২০০৯ সালের ন্যায় এবার চমক থাকছে মন্ত্রিসভায়। ছিটকে পড়তে পারে গতবারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। জাতীয়পার্টিকে বিরোধী দলেও রাখা হতে পারে। তবে সেটা পুরো নির্ভর করছে জাতীয়পার্টির ওপর। তারা চাইলে বিরোধীদলেও যেতে পারে। অন্যথায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকার গঠন করা হবে। দলের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, ক্লিন ইমেজের অভিজ্ঞ পুরনো এবং নবীন নেতাদের নিয়ে সাজানো হচ্ছে এবারের মন্ত্রিসভা। আইন ও অর্থমন্ত্রীর ক্ষেত্রে চমক আসতে পারে বলে জানা গেছে। গত বুধবার রাতে দলের নীতিনির্ধারণী মহলের সাথে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুজন অর্থমন্ত্রী ও দুজন আইনমন্ত্রীর নাম চেয়েছেন। এতে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও অ্যাডভোকেট আনিসুল হকের নাম উঠে আসে আইনমন্ত্রীর তালিকায়। অপরদিকে অর্থমন্ত্রী হিসেবে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমে ইতোমধ্যেই বলেছেন, সরকারে এবার বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। বিদ্যমান সংবিধানে একটি সংসদ চলমান থাকায় আরেকটি সংসদ গঠনের সুযোগ নেই। সে অনুযায়ী সরকারও প্রথম দিকে চলতি মাসের শেষে নতুন সরকার গঠনের কথা ভেবেছিলো। কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং জামায়াত-বিএনপির অব্যাহত সহিংসতা আমলে নিয়ে দ্রুত সরকার গঠন করতে আইন খতিয়ে দেখার জন্য কয়েক দফা বৈঠক করে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি। তারা সাবেক আইনমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ আইনজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করেন। পয়লা জানুয়ারি রাতে তিন দফা বৈঠক করে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি। এরপর তারা নির্বাচন কমিশনের কাছে যায়।

এদিকে ২৪ জানুয়ারির আগে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণে কোনো আইনি জটিলতা নেই বলে আইন বিশেষজ্ঞরা সরকারের শীর্ষ পর্যায়কে জানিয়েছেন বলে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির একটি সূত্র জানিয়েছে। ২৪ জানুয়ারির আগে নতুন সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণে কোনো প্রকার বাধা আছে কি-না সে বিষয়ে জানতে আবারও আইনজ্ঞদের সাথে বৈঠক করেছে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি। বিশেষজ্ঞরা সরকারকে আইনি পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ নেয়ার সাথে সাথেই নবম সংসদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে আইনি বা সাংবিধানিক কোনো জটিলতা দেখা দেবে না।

এদিকে গত মঙ্গলবার রাতে ১৪ দলের নেতারাও দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকার গঠনের ব্যাপারে মত দিয়েছেন বলে জানা যায়। ১৪ দলের কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, সরকার গঠন করতে যতো দেরি হবে বিএনপি-জামায়াত ততো সহিংসতা করতে সাহস পাবে। আর একবার সরকার গঠন করে ফেলতে পারলে তখন তারা বেশি বাড়াবাড়ি করতে সাহস পাবে না। তাদের দমন করা সহজ হবে। প্রশাসনও চাঙ্গা হবে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে তারা এ পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান ১৪ দল নেতারা। মন্ত্রিত্ব দেয়ার ব্যাপারে জোটের নেতারা বলেন, যেসব দলের নেতারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি তাদের মূল্যায়ন করা হবে বলে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এমন দু একজনকে মন্ত্রীও করা হতে পারে বলে জানা গেছে।

আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি সূত্র জানায়, স্পিকার নির্বাচন করার লক্ষ্যে দ্রুতই সংরক্ষিত আসনের মহিলা এমপিদের নির্বাচিত করা হবে। বর্তমান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সরাসরি সংসদ সদস্য না হওয়ায় তাকে স্পিকার করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করা হবে।