সমাধানের উপায় বের করতে দিনভর নানামুখি তৎপরতা : ইতিবাচক অগ্রগতি

স্টাফ রিপোর্টার: ঢাকা সফরের পাঁচ দিনের মাথায় প্রধান দুই দলের রাজনীতিকদের আলোচনার টেবিলে বসালেন জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। দিনভর গণমাধ্যমের সাথে লুকোছাপা করে অনুষ্ঠিত এ বৈঠককে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের এ দূত ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

গতকাল দুপুরে তারানকোর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দু দলই আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলেছে। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন, আলোচনা শুরুর জন্য বিরোধী দলকে অবরোধ তুলে দিতে হবে, জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ করতে হবে। আর বিএনপির নেতারা বলেছেন, দলের নেতাদের মুক্তি, দলীয় কার্যালয় খুলে দেয়া এবং সমাবেশ করার অনুমতি দিলে তবেই আলোচনা হতে পারে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতা এবং নির্বাচনী সংকট নিরসনে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সমঝোতার মিশনে নাটকীয় মোড় নিয়েছে। তবে মঙ্গলবার পর্যন্ত দু পক্ষের মধ্যে সংলাপে কার্যকর কোনো ফল বের হয়ে আসেনি। নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, পরিবেশ সৃষ্টির দাবি জানিয়ে বিএনপি বলেছে, তারা নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনায় রাজি আছে। কিন্তু সবার আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের পুনঃতফসিল ঘোষণা করতে হবে। তারা প্রশ্ন তোলেন, তফসিল পিছিয়ে দেয়া না হলে বিএনপি কীভাবে নির্বাচনে যাবে? এছাড়া কার্যকর সংলাপের আগে বিএনপির গ্রেফতারকৃত সব নেতাকর্মীর মুক্তি এবং দলীয় কার্যালয় থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবরোধ সরিয়ে নেয়ারও দাবি তোলে বিএনপি। তবে এসব প্রশ্নে সরকার পক্ষ জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করেই তারা অগ্রগতি জানাবে। দু পক্ষই আবারও বৈঠকে বসতে সম্মত হয়েছে। এছাড়া ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে দু পক্ষই বিবৃতি দেবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। তবে তারানকোর চারদিনের অব্যাহত প্রচেষ্টায় সদিচ্ছা ও কিছুটা ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে প্রধান দু দল সংলাপে বসতে সক্ষম হয়েছে। তারানকোর উপস্থিতিতে মঙ্গলবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিনিধিরা প্রথম দফায় সংলাপে বসেন। ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি নিল ওয়াকারের গুলশানের বাসভবনে বেলা আড়াইটা থেকে প্রায় দু ঘণ্টা এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সংলাপে আওয়ামী লীগের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ড. আবদুল মঈন খান। এই সংলাপে সমঝোতার ব্যাপারে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে প্রধান দু দলের মধ্যে সংলাপে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান সফররত জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত তারানকো। চারদিনের মিশন সম্পর্কে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সোনারগাঁও হোটেলে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বর্তমান সংকট নিরসনে ও সমঝোতায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে সদিচ্ছা ও ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে সংলাপ চালিয়ে যেতে উভয় দল সম্মত হয়েছে। পারস্পরিক আস্থা অর্জনে একসাথে এগিয়ে যেতে তারা রাজি হয়েছেন। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্বে দায়িত্বশীল ও সাহসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে। এটি জনগণের প্রত্যাশা পূরণের পথে একটি অগ্রগতি। তিনি বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে উভয় দলের প্রতিনিধিদের মধ্যে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। উভয় দল সংলাপে বসে এই সুযোগ গ্রহণ করায় তিনি তাদের ধন্যবাদ জানান। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে আজকের এই দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্র্ণ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সংকট নিরসনে সমঝোতার পথে ইতিবাচক অগ্রগতি হওয়ায় আমার বাংলাদেশ সফর আরও একদিন বেড়ে গেছে। আগামী দিনগুলোতে আরও অগ্রগতি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

উল্লেখ্য, চারদিনের সফর শেষে মঙ্গলবার তারানকোর ঢাকা ত্যাগ করার কথা ছিলো। কিন্তু সফরের মেয়াদ একদিন বাড়ানোয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দ্বিতীয় দফার বৈঠক পিছিয়ে আজ অনুষ্ঠিত হবে। এরপর রাতে তার ঢাকা ত্যাগ করার কথা রয়েছে। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আরও কিছুটা অগ্রগতির চেষ্টা করতেই তার নির্ধারিত সফরের মেয়াদ একদিন বাড়ানো হয়। বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে অব্যাহত রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার মধ্যে শুক্রবার ঢাকায় আসেন বান কি মুনের দূত ও রাজনৈতিকবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো।

সংলাপ অব্যাহত রাখতে একমত হয়েছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ: জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সাথে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে উভয়পক্ষই সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখার বিষয়ে একমত পোষণ করেন বলে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। বৈঠকে কখন, কোথায় ও কারা কারা উপস্থিত ছিলেন তা উল্লেখ করে মিডিয়ায় এক বিবৃতি পাঠায় বিএনপি।

দলের সহদফতর সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়, সফররত জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর আমন্ত্রণে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক কো-অর্ডিনেটরের বাসভবনে মঙ্গলবার বেলা ২টায় আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। বিএনপির প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুল মঈন খান এবং ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী।

অপরদিকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দলটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা ছিলেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ ও গওহর রিজভী। তারানকো ছাড়াও জাতিসংঘের অন্য কর্মকর্তারাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। বিবৃতিতে বাংলাদেশের আগামী সংসদীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরাজমান অনিশ্চয়তা নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের মহাসচিবের এ উদ্যোগের জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানানো হয়।

এদিকে তারানকোর সাথে বৈঠকের পর রাতে চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে বিএনপি। বৈঠকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক, সাবিহউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। দীর্ঘক্ষণ চলা বৈঠকে তারানকোর সাথে আলোচনার সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। এছাড়া নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে দলের সর্বশেষ অবস্থান স্পষ্ট করার বিষয়টিও আলোচনায় আসে। সরকারের সাথে আনুষ্ঠানিক সংলাপ হলে তার একটি আলোচ্যসূচির খসড়া নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয় বলে জানা গেছে।

এদিকে বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড.খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকের বলেছেন, আগামী নির্বাচনকালীন সংকট সমাধানে আলোচনার সূত্রপাত ঘটেছে। এখনই মন্তব্য করার সময় হয়নি। অত্যন্ত সৌহাদ্যপূর্ণ পরিবেশে দুই ঘণ্টা জাতিসংঘ প্রতিনিধির সাথে বৈঠক হয়েছে। খন্দকার মোশাররফ বলেন, আলোচনা চালিয়ে যাব, যতো শিগগির সম্ভব আবারও আলোচনায় বসব। আলোচনা অব্যাহত আছে। আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে বলার সময় হয়নি।