সব পক্ষকে পরিণতি ভাবার আহ্বান রবার্ট গিবসনের

স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডব্লিউ গিবসন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে তাদের কর্মের পরিণতি সম্পর্কে ভাবার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি বর্তমান অচলাবস্থা নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেন তিনি। গতকাল বুধবার বিকেল ৫টার দিকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে তার সাথে দেখা করেন গিবসন। প্রায় এক ঘণ্টার বৈঠক শেষে কার্যালয় থেকে বের হয় একটি লিখিত বিবৃতি পড়ে শোনান তিনি।

ব্রিটিশ হাইকমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, তিনি খালেদা জিয়াকে কোকোর মৃত্যুতে সমবেদনা জানিয়েছেন। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি আগেও বলেছি, বর্তমান সহিংসতা এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ার ঘটনা অব্যাহত থাকা দুঃখজনক ও নিন্দনীয়।

গিবসন বলেন, আমি ক্রমাগতভাবে সব পক্ষকে আহ্বান জানিয়ে আসছি তারা যেন কর্মের পরিণতি সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে ভাবেন। পাশাপাশি জাতীয় স্বার্থহানিকর কাজ থেকে বিরত থাকেন। আমি সব পক্ষকে আরো আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনতে এবং আস্থা গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, যা দেশের বর্তমান অস্থিরতা নিরসন করবে। তিনি আরো বলেন, আমি প্রত্যাশা করি এ আস্থা গড়ার প্রক্রিয়া দীর্ঘ মেয়াদে জোরদার হবে, যা বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সহিংসতা এবং বিঘ্ন সৃষ্টির যে অভ্যাসগত চরিত্র, তার বিলুপ্তি ঘটাবে। পাশাপাশি সব বৈধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শান্তিপূর্ণভাবে পালনে অনুমোদন করবে।

লাগাতার অবরোধ ডেকে এক মাসের বেশি সময় ধরে গুলশানের ওই কার্যালয়ে অবস্থানরত বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে এটাই বিদেশি কোনো কূটনীতিকের প্রথম সাক্ষাৎ। ফলে এই বৈঠক নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ কৌতূহল ছিলো। কার্যালয়ের দোতলায় খালেদা জিয়ার চেম্বারে তার সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন গিবসন। সচরাচর এ ধরনের বৈঠকে কয়েকজন উপদেষ্টা থাকলেও এই বৈঠকে তাদের কাউকে সাথে রাখেননি বিএনপি চেয়ারপারসন। ঘণ্টাব্যাপি বৈঠকের পর উপস্থিত সাংবাদিকদের লিখিত একটি বক্তব্য পড়ে শোনান যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার।

এর আগে খালেদার কার্যালয়ের ফটকে রবার্ট গিবসনকে অভ্যর্থনা জানান বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান ও বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস।

হাইকমিশনারের পতাকাবাহী ল্যান্ড ক্রুজার গাড়িটি বিকেল ৪টা ৫৬ মিনিটে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের ফটক দিয়ে ভেতরে ঢোকে। ৩ জানুয়ারি খালেদা জিয়া এ কার্যালয়ে অবস্থান নেয়ার পর থেকে প্রধান ফটকটি বন্ধ ছিলো। ফটক ঘেঁষে রাখা কারটিও সরিয়ে নেয়া হয় হাইকমিশনারের গাড়িটি আসার কয়েক মিনিট আগে।

২৪ জানুয়ারি কোকোর মৃত্যুর পরদিন ব্রিটিশ হাইকমিশনারসহ কয়েকজন কূটনীতিক গুলশানের কার্যালয়ে শোকবইতে স্বাক্ষর করতে এলেও তখন বিএনপি চেয়ারপারসনের সাথে সাক্ষাৎ হয়নি।
জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ চায় বিএনপি: এদিকে অবরোধ-হরতালে অর্ধ শতাধিক মানুষের প্রাণহানির পর রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটাতে এখন জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ চাইছে বিএনপি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেছেন, চলমান অচলাবস্থা নিরসনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংলাপ আয়োজনে জাতিসংঘের যে কোনো উদ্যোগকে স্বাগত জানাবেন তারা। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দেয়া সংলাপের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের দিনই এক সাক্ষাৎকারে দলের এ অবস্থান জানালেন মঈন খান।

সংলাপ আয়োজনে জাতিসংঘের সহায়তা চাওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় মঈন খান বলেন, ‘বিএনপির অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাসহ প্রায় ১০ হাজার কর্মী মিথ্যা মামলায় আটক আছেন। সংলাপে বসার মতো গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেশে নাই।’ বিএনপির প্রবীণ এ নেতা মনে করেন, ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং চীনের মধ্যে সেতুবন্ধন হওয়ায় এখানের কোনো সমস্যায় ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মতো এ অঞ্চলের প্রভাবশালী দেশগুলোর উদ্বেগের কারণ রয়েছে।
‘বাংলাদেশের বর্তমান অচলাবস্থার দ্রুত সমাধান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও স্বার্থসংশ্লিষ্ট’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

একমাত্র আলোচনাই সঙ্কটের সমাধান আনতে পারে বলে মনে করেন মঈন খান।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যে কোনো সঙ্কট উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে আলোচনা। আলোচনা ব্যর্থ হলে পরবর্তী পদক্ষেপও হবে আলোচনাই। সহিংস আন্দোলনের পক্ষে ব্যাখ্যা দিয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, গণতান্ত্রিক আচরণ ও মূল্যবোধের অভাবে দীর্ঘ সময় ধরে সৃষ্ট রাজনৈতিক দ্বন্দ্বেরই ফল হচ্ছে এই সহিংসতা। চলমান সহিংসতাকে রোগ নয়, রোগের উপসর্গ বলে মন্তব্য করে এর সাথে বিএনপির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ নাকচ করেন মঈন খান। নাশকতার জন্য উল্টো সরকারের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে তিনি বলেন, সবচেয়ে আশ্চর্যের বিস্ময়, সরকার এখনো কোনো একজন চিহ্নিত অপরাধীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়নি। তারা (অপরাধীরা) শাসক দলের সহায়তা পাচ্ছে। আমাদের বদনামের জন্য নাশকতা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারি সারাদেশে লাগাতার অবরোধের ডাক দেয়ার পর প্রতিদিনই গাড়িতে অগি্নসংযোগ, অগ্নিবোমা নিক্ষেপ ও বোমাবাজির ঘটনা ঘটছে।
নাশকতার এসব ঘটনায় এরই মধ্যে আগুনে পুড়ে অর্ধ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

নির্যাতনে স্বীকারোক্তি আদায়: বিএনপি অভিযোগ করেছে, নির্যাতনের মুখে কিছু ব্যক্তিকে দিয়ে নাশকতার সাথে বিএনপি ও ২০ দলের নেতারা জড়িত বলে স্বীকারোক্তি আদায় করা হচ্ছে। বুধবার এক বিবৃতিতে দলটির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ এ অভিযোগ করেন। তিনি আবার দাবি করেন, অবরোধ চলাকালে বিভিন্ন স্থানে নাশকতার যেসব ঘটনা ঘটছে, তার সাথে বিএনপি বা জোটের কোনো সংযোগ নেই।

বিবৃতিতে সালাহ উদ্দিন বলেন, চলমান গণ-আন্দোলন কলুষিত করার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পুলিশ রিমান্ডে অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে কিছু অভিযুক্ত ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তি আদায় করা হচ্ছে। তাদের মুখ দিয়ে বলানো হচ্ছে, নাশকতার সাথে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতারা জড়িত। পরিকল্পিতভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত ও দলকানা কতিপয় গণমাধ্যমে তা দিনরাত ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে।

বিবৃতিতে দাবি করা হয়, সরকারি দলের দুর্বৃত্তরা অগ্নিবোমা ও অন্যান্য অবৈধ অস্ত্রসহ বিভিন্ন জায়গায় ধরা পড়লেও তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে না। সরকারপন্থি বিভিন্ন সংগঠন বিএনপির চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার চেষ্টা করছে এমন দাবি করে বিবৃতিতে বলা হয়, খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার যে কোনো প্রচেষ্টা শাসকশ্রেণির নিরাপত্তা বেষ্টনীকেই বরং দুর্বল করে তুলতে পারে।