সব কূল হারালেন লতিফ সিদ্দিকী : কটুক্তির আড়ালে পূর্ব পরিকল্পনা?

 

স্টাফ রিপোর্টার: শুধু মন্ত্রিত্ব আর দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদই নয়, আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য পদও হারাতে যাচ্ছেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। এমনকি সংসদ সদস্য পদও হারাতে পারেন তিনি। পাশাপাশি বিগত মহাজোট সরকার ও বর্তমান সরকারের মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে একাধিক মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যেই এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে বস্ত্র ও পাট এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। এ দু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও পৃথক তদন্ত কমিটি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া ঈদুল আজহার পর তার দুর্নীতির অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেবে দুর্নীতি দমন কমশিন (দুদক)। সরকারের নীতি-নির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। অপরদিকে প্রশ্ন উঠেছে, তিনি কি বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্যই হজ, তাবলিগ জামায়াত ও প্রধানমন্ত্রীর ছেলে জয়কে সম্পর্কে কটুক্তি করেছেন? অবশ্য এ প্রশ্নের চেয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ায় তাকে দেশে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হবে কি-না সে প্রশ্নই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ইতোমধ্যেই আমেরিকা বা কানাডায় তিনি থেকে যাচ্ছেন বলে একাধিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। সে কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, তিনি কি প্রবাসে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার জন্যই পূর্ব পরিকল্পিতভাবে দেশের ধর্মপ্রাণ মসুল্লিদের আঘাত করে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চেয়েছেন?
গত রোববার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে টাঙ্গাইল সমিতির এক অনুষ্ঠানে হজ, তাবলিগ জামায়াত ও প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন লতিফ সিদ্দিকী। তার এ বক্তব্যে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সারাদেশে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৬টি মামলাও হয়। এরপরও লতিফ সিদ্দিকী তার এ বক্তব্যে অনড় থাকেন এবং এটি প্রত্যাহার না করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পাশাপাশি দল থেকে বহিষ্কারেরও সিদ্ধান্ত নেয় ক্ষমতাসীনরা। পবিত্র মক্কায় হজ পালনরত রাষ্ট্রপতি দেশে ফিরলেই মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্তটি কার্যকর হবে।

মন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ হারাচ্ছেন: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে শুধু মন্ত্রিসভা থেকেই নয়, দল থেকেও বহিষ্কার করা হবে। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে আওয়ামী লীগের সিলেটে বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহউদ্দিন সিরাজ এ কথা বলেন। লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর বৃহস্পতিবার সিলেট বিমানবন্দরে শেখ হাসিনার সাথে কথা হয় সিরাজের। মিসবাহউদ্দিন সিরাজ জানান, হজ নিয়ে কটূক্তি করায় প্রধানমন্ত্রী অনেক দুঃখ পেয়েছেন। সকালে প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেছেন, আমেরিকায় বসেই তিনি (শেখ হাসিনা) লতিফ সিদ্দিকীকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সিরাজ জানান, প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেছেন কোনো সুস্থ মানুষ ধর্মীয় অনুভূতিতে এ রকম আঘাত করতে পারে না। হজ ইসলামের একটি মৌলিক স্তম্ভ। আমি নিজেও বেশ কয়েকবার হজ-ওমরাহ পালন করেছি। এমনকি আমি আমার দাদা-দাদির বদলি হজও করেছি। কাজেই আমার মন্ত্রিসভা এবং দলের কেউ হজ সম্পর্কে এরকম বক্তব্য দেবে- এটা কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বৃহস্পতিবার শেরপুরে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি পরহেজগার। তাই তিনি সাথে সাথে লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়েছেন। তিনি এখন মন্ত্রিসভায় নেই। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা যেহেতু রাষ্ট্রপতির মাধ্যমেই করতে হয়, তাই তিনি দেশে ফিরলে বাকি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হবে। মতিয়া চৌধুরী আরও বলেন, লতিফ সিদ্দিকী যা করেছেন তার জন্য তাকেই মাশুল দিতে হবে। এটার দায়দায়িত্ব শেখ হাসিনার সরকার বা আওয়ামী লীগ গ্রহণ করবে না।

এদিকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ৮টি গুরুত্বপূর্ণ নথির প্রাথমিক পর্যালোচনায় লতিফ সিদ্দিকীর নানা অনিয়মের সত্যতা মিলেছে। প্রয়োজনীয় মতামতের জন্য নথিগুলো আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তাদের মতামতের ভিত্তিতে সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বৃহস্পতিবার নিজ দফতরে বলেন, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর অনিয়ম ও দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পেয়েছি। সেখানে তার বিরুদ্ধে অর্ধশত অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। আমরা সুপারিশ অনুযায়ী কঠোরভাবে আইনগত ব্যবস্থা নেব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাবেক মন্ত্রীর অনিয়ম ও দুর্নীতির বেশ কয়েকটি ফাইলের আইনগত বিষয় খতিয়ে দেখতে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তাদের মতামত পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জানতে চাইলে,আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, দল থেকে বহিষ্কার করা হলে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্যপদও থাকবে না। বিদ্যমান সংবিধানেই বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, জনগণ আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে ভোট দেয়নি, আওয়ামী লীগকে দিয়েছে। তাই তার আর সংসদ সদস্যপদ থাকে না।

খতিয়ে দেখবে সংসদীয় কমিটি: আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর দুর্নীতি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংসদীয় কমিটি। পাশাপাশি তিনি দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন কি-না তাও অনুসন্ধান করা হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের দু মেয়াদে মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংসদীয় কমিটি। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আলাদাভাবে তদন্ত কমিটি গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইমরান আহমদ কাছে এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেছেন।

ঈদের পর দুদকের সিদ্ধান্ত: দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেবে ঈদুল আজহার পর। ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ গ্রহণ, চট্টগ্রামের একটি সমিতিকে বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কমে জমি প্রদানসহ বিভিন্ন অভিযোগ ইতোমধ্যেই কমিশনে জমা পড়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. নাসির উদ্দীন আহমেদ বলেন, দুদক চেয়ারম্যান আজ আমেরিকা থেকে ফিরে মাত্র অফিসে এলেন। আমরা সৌজন্য বৈঠক করেছি। এ বিষয়ে কোনো কথা হয়নি। লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে অনুসন্ধান শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে ঈদের পর।

এখনই দেশে ফেরা নয়: এখনই দেশে ফিরছেন না বিতর্কিত বক্তব্য রাখার দায়ে তোপের মুখে থাকা ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। সরকারের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে এখনি দেশে ফিরতে নিষেধ করেছেন সরকারের নীতিনির্ধারক মহল। লতিফ সিদ্দিকী দেশে ফিরলে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। বিএনপি ও ইসলামী দলগুলো এ ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। যা সামাল দেয়া সরকারের জন্যও কঠিন হতে পারে। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে আপাতত তাকে দেশে ফিরতে নিষেধ করা হয়েছে।