সন্দেহ সংশয় তবুও সবার দৃষ্টি সিটি নির্বাচনে

রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি

 

স্টাফ রিপোর্টার: ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচন আইন অনুযায়ী স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও চলমান পরিস্থিতিতে এটি মূলত জাতীয় রাজনীতিতে নতুন মোড় হিসেবে সামনে চলে এসেছে। গত টানা আড়াই মাসেরও বেশি সময় দেশের মানুষের দৃষ্টি ছিলো অবরোধ-হরতালকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘাত-সংঘর্ষ, বিদেশি কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তত্পরতা ও রাজনৈতিক পটপরিক্রমায়। সেখান থেকে এখন জনদৃষ্টি ঘুরছে তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিকে। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংশয় রয়েছে, আছে পারস্পরিক সন্দেহও। তবুও প্রায় সব মহলেই আলোচনার শীর্ষে সিটি করপোরশেন নির্বাচন। বিশেষ করে, দেশের প্রধান দু শহর- রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাসিন্দারের চোখ এখন এ নির্বাচনের দিকে। যার কমবেশি ছোঁয়া লেগেছে প্রায় গোটা দেশেই।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের অবরোধ-হরতালকে কেন্দ্র করে পেট্রোলবোমায় মানুয় পুড়িয়ে মারাসহ নানা অমানবিক ঘটনায় টানা গত ৭৮ দিন ধরে জনগণ এক ধরনের উত্কণ্ঠা ও অজানা ভীতিতে। মাঝখানে পেট্রোলবোমার আক্রমণ প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। তবে গত কয়েকদিনে বিচ্ছিন্নভাবে আবারও দেশের কয়েকটি স্থানে যানবাহনে পেট্রোলবোমা মেরে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। আগের তুলনায় সংখ্যার দিক থেকে অনেক কম হলেও ঘটছে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও। তারপরেও এখন ঢাকা-চট্টগ্রামের সর্বত্র আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে সিটি করপোরেশন নির্বাচন। দেশের অন্যান্য স্থানেও এখন হরতাল-অবরোধের পরিবর্তে এ নির্বাচনই আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে। এমনকি গণমাধ্যমও হরতাল- অবরোধের খবরাখবরের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের নানামুখি প্রতিবেদন।

অবশ্য তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আদৌ হবে কি-না, শেষ পর্যন্ত বিএনপি অংশ নিলে সরকার নির্বাচনে স্থির থাকবে কি-না, এ নিয়ে এরই মধ্যে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে শুক্রবারসহ গত কয়েক দিনে দলের নেতাদের সাথে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন নির্বাচন হবে। আমরা হারতেও প্রস্তুত। অনেক সময় হারার জন্যও নির্বাচন দিতে হয়।

বিএনপিসহ ২০ দল যখন দশম জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে মধ্যবর্তী জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত, তখন হঠাত তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসার বিষয়ে রাজনীতি বিশ্লেষক ও বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক গতকাল সোমবার ইত্তেফাকের সাথে আলাপকালে বলেন, প্রথম কথা-আমাদের এখানে রাজনীতি মূলত নির্বাচনকেন্দ্রিক। যদিও রাজনীতিতে এখন যৌক্তিকতার বালাই নেই। দেশে যখন আন্দোলন ও নির্মম সহিংসতা চলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যখন কোনো ধরনের জবাবদিহিতা নেই, শিক্ষা-অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত-তখন রাজনীতির সব পক্ষই যৌক্তিক-অযৌক্তিকতার দিকে না তাকিয়ে নিজ স্বার্থের অনুকূলে কাজ করবে-এটিই স্বাভাবিক।

শাহ্দীন বলেন, সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সেটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক হবে, জাতীয় রাজনীতিতেও তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। গত ৪ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক সহিংসতা এবং ২০ দলের ৬ জানুয়ারি থেকে লাগাতার অবরোধ ও পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে সপ্তায় পাঁচদিন করে চলতে থাকা হরতালের মাঝে তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ইস্যু সামনে চলা আসায়-এর রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি। নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে বিএনপি ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করায় নতুন করে হিসাব-নিকাষ করছেন ক্ষমতাসীনেরাও। বিএনপি সক্রিয়ভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলে-এর ভালো-মন্দ সবদিক বিচার-বিশ্লেষণ করছেন তারা। একইভাবে নতুন সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বিরতিহীন আন্দোলনরত বিএনপিও পড়েছে উভয় সঙ্কটে। এ অবস্থায় নির্বাচনে গেলে মূল দাবির পরিণতি কী হবে, নির্বাচন বর্জন করলে এর সুফল বা কুফল কী হবে সেই হিসাব এখনও মেলাতে পারেনি বিএনপি নেতৃত্ব। এনিয়ে কার্যত: এখনও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে বিএনপি।

প্রধান দু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের এই রাজনৈতিক রসায়ন ভাবনা সম্পর্কে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ গতকাল বলেন ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও আন্দোলনকে এক করে দেখা উচিত নয়। একটিকে আরেকটি থেকে আলাদা রাখা উচিত। নতুন সংসদ নির্বাচনের জন্য স্থানীয় সরকার নির্বাচন আটকে থাকতে পারে না। ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আট বছর ধরে হয়নি, এটাতো সবার জানা। সরকার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এটিকে সামনে নিয়ে এলেও নির্বাচনটি হওয়া দরকার। জাতীয় রাজনীতি থেকে এই নির্বাচনকে আলাদা রেখে সব পক্ষ যার যার রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করতে পারে। এই নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির আন্দোলনের অঙ্গহানি ঘটবে, কিংবা অংশ না নিলে তাদের আন্দোলন জোরদার হবে-এমন আমার মনে হয় না।

চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আসন্ন এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সরকার ও বিএনপি- উভয় পক্ষের জন্যই একটা সুযোগ বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, হরতাল-অবরোধে ছন্দপতন ঘটিয়ে বিএনপিকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনমুখি করা গেলে-সেটি সরকারের জন্য অবশ্যই স্বস্তিদায়ক হবে। আবার ডেডলক অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য বিএনপিরও এ নির্বাচনকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত বলে মত দিচ্ছেন তারা।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এরইমধ্যে এ প্রসঙ্গে বলেছেন অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি থেকে বের হয়ে আসার জন্য সিটি করপোরেশন নির্বাচন বিএনপিকে সুযোগ করে দিয়েছে। এটি বিএনপির জন্য এক্সিট পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে। বিএনপির উচিত নির্বাচনে অংশ নেয়া।

এদিকে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলে-শেষ পর্যন্ত সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন কয়েকজন। বিশেষ করে, বিএনপির বড় একটি অংশের সন্দেহ, তারা নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিলে সরকার নির্বাচন থেকে সটকে পড়তে পারে। আবার নির্বাচন হলেও তা সুষ্ঠু হবে কি-না, তা নিয়েও কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করেছেন।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন বিএনপি নির্বাচনে গেলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হবে। সেজন্য বিএনপি নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিলে সরকার আর এ নির্বাচন করবে না। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীও গতকাল বলেছেন, নির্বাচন আসলে হবে কি-না, এনিয়ে আমার এখনও সংশয় আছে। আর নির্বাচন হলেও সেটি কতখানি নিরপেক্ষ হবে- তা নিয়ে আমার পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীও শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন বিএনপি অংশ নিলে আওয়ামী লীগ আর এই নির্বাচন করবে না।

তবে নির্বাচন অনুষ্ঠান ও তা সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে এই সংশয়কে অমূলক দাবি করে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ভবনে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন আমরা চাই সবার অংশগ্রহণে এ নির্বাচন হোক। তাতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা হেরে গেলেও আমরা ফল মেনে নেবো। যেই হারুক বা যেই জিতুক, নির্বাচনে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হবে না। এর আগেও চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, রাজশাহী ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকার সেটি প্রমাণ করেছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংশয়-অবিশ্বাস থাকলেও ঢাকা ও চট্টগ্রামে এরই মধ্যে ভোটের হাওয়া  বইতে শুরু হয়ে গেছে। দু নগরী ছেয়ে গেছে সম্ভাব্য মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের পোস্টার, ব্যানারে। চলছে গণসংযোগ ও মতবিনিময় সভা। সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকে ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্রও সংগ্রহ করেছেন। রাজধানী ও চট্টগ্রামের পাড়া-মহল্লা, অফিস-আদালত ও দোকান-ফটুপাতের সর্বত্রই এখন ভোটের আলোচনা।