সন্তান হত্যার বিচার চাওয়ার বিষয়ে স্বামী-স্ত্রীর পৃথক অবস্থান : সাক্ষী হতে চেয়ে গ্রেফতার

 

ভুন্দির মা সাবিনা অপহৃত হয়েছেন বলে থানায় পিতার মামলা : সংবাদ সম্মেলনে মাসহ দু বোন বললেন ওই মামলা মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক

 

স্কুলছাত্রীমৃত্যুরহস্যের জট খুলতে সোচ্চার গ্রামবাসী : আদালতে আজ মামলা হতে পারে : আইন সহায়তায় পাশে দাঁড়িয়েছে লোকমোর্চা

স্টাফ রিপোর্টার: আলমডাঙ্গার হাড়োকান্দি গ্রামের শিশু ভুন্দি মৃত্যু রহস্য উন্মোচন নিয়ে নাটকীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভুন্দির মা সাবিনা বেগম চান তার মেয়ের হত্যারহস্যের জট খুলুক। এ জন্যই তিনি আদালতে মামলা করার জন্য এসেছিলেন চুয়াডাঙ্গায়। কিন্তু পুলিশের খাতায় তিনি হয়ে গেছেন অপহৃত। তার স্বামী আবুল কাশেম থানায় মামলা করেছেন সাবিনাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে। মামলা করার সাথে সাথে আটকও করা হয় তিনজনকে। তবে গতরাতে একজনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে ভুন্দির মা গতরাতে চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, তার মেয়ের হত্যাকারীদেরকে বাঁচানোর জন্যই শুরু হয়েছে নানা ষড়যন্ত্র। জেলা লোকমোর্চার সহযোগিতায় তিনি আজ আদালতে মামলা করবেন বলে সাংবাদিকদের জানান।

অভিযোগসূত্রে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার আইলহাস ইউনিয়নের একটি গ্রাম হাড়োকান্দি। এ গ্রামের দরিদ্র আবুল কাশেমের মেয়ে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতুল আরা ওরফে ভুন্দির (১১) লাশ পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয় গত ১ সেপ্টেম্বর। ভুন্দি আগের দিন ৩১ আগস্ট সকালে গ্রামের নুড়িতলার মাঠে তাল কুড়োতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। গ্রামের মাদরাসার শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন ও মসজিদের মোয়াজ্জিন হাবিবুর রহমান প্রচার করতে থাকেন তাকে জিনে নিয়ে গেছে। পরদিন নুড়িতলা মাঠের আনারুলের পুকুর থেকে লাশ উদ্ধারের পর প্রচার করা হয় তাকে জিনে মেরে ফেলেছে। আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফনের অনুমতি দেয়। কিন্তু গ্রামে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে ওসমান আলীর ছেলে ভুন্দির চাচাতো ভাই জাকির ধর্ষণ শেষে ভুন্দিকে হত্যা করে পুকুরে ডুবিয়ে রাখে। দাবি ওঠে ভুন্দির মৃত্যুরহস্য উন্মোচনের। কয়েকদিনের মধ্যে ধর্ষণ ও হত্যার বিষয়টি গ্রামবাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন একই গ্রামের মদন কুমার সাধুখা বলতে থাকে জাকিরের সাথে ভুন্দিকে তালতলায় দেখেছেন তিনি। এ নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকে গ্রামবাসীসহ বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা। গত ৪ সেপ্টেম্বর হাড়োকান্দি-বলেশ্বরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হাড়োকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বলেশ্বরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ভুন্দি হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন করে এবং হত্যাকারী যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানায়। এরই মধ্যে ভুন্দির বোন আমেনা খাতুন ও দুলাভাই সায়েদ আলী গত ৫ সেপ্টেম্বর আলমডাঙ্গা থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু পুলিশ মামলা না নিলে তারা জেলা লোকমোর্চার সহায়তায় মামলা করার উদ্যোগ নেন।

গতকাল রোববার সকালে মেয়ে আমেনা খাতুন ও মোমেনা খাতুনকে সাথে নিয়ে ভুন্দির মা সাবিনা বেগম চুয়াডাঙ্গায় আসেন আদালতে মামলা করার জন্য। মামলার সাক্ষী হিসেবে আসেন ভুন্দির লালন-পালনকারী গিয়াস উদ্দিন ডাবলু, হাড়োকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি মিনাজ উদ্দীন, আব্দুল মান্নান গোলজার ও সায়েদ আলী। মামলার প্রস্তুতি নিতে সময় চলে যাওয়ার কারণে ভুন্দির মা সাবিনা আগামীকাল (আজ) মামলার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে সাক্ষীরা বাড়িতে ফিরে যান। এরই মধ্যে নাটকীয়ভাবে ঘটে আরেক ঘটনা। সাবিনাকে অপহরণ করা হয়েছে মর্মে থানায় মামলা করেন তার স্বামী আবুল কাশেম। এ মামলায় গতকালই গিয়াস উদ্দিন ডাবলু, মিনাজ উদ্দিন ও আব্দুল হামিদকে গ্রেফতার করে আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ। এ ঘটনার পর ফুঁসে ওঠে গ্রামবাসী। কয়েকশ গ্রামবাসী তাদের মুক্তির দাবিতে আলমডাঙ্গা থানা ঘেরাও করে। পরে রাতে আব্দুল হামিদকে ছেড়ে দেয়া হয় বলে গ্রামবাসী জানায়।

এদিকে গতরাত ৮টায় জেলা লোকমোর্চার সহযোগিতায় সাংবাদিক সম্মেলন করেন ভুন্দির মা সাবিনা বেগম। তার পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন তার বড় মেয়ে আমেনা খাতুন। এ সময় তার সাথে ছিলেন আরেক মেয়ে মোমেনা খাতুন। লিখিত বক্তব্যে বলা হয় ‘১ সেপ্টেম্বর ভুন্দির লাশ উদ্ধারের পর লাশের গোসল দেন গ্রামের শামসুলের স্ত্রী জোছনা, আতিয়ারের স্ত্রী হেনা বেগম ও রইছ উদ্দিনের স্ত্রী। গোসল দেয়ার পর তারা জানান, ভুন্দির দুটি দাঁত ভাঙা ছিলো। গলাসহ সমস্ত শরীরে ফোলা ও ফোঁসকা ছিলো। মুখের ভেতরে জমাট রক্ত ছিলো। ভুন্দির লাশ উদ্ধারের পর থেকেই আমাদের পরিবারের সবাই ভাসুর ওসমান আলীর ছেলে জাকির হোসেনকে সন্দেহের চোখে দেখি। জাকিরের বিরুদ্ধে মামলা করতে চাইলে তার বড় ভাই ইসরাফিল হোসেন ওরফে জমশের নানাভাবে হুমকি-ধামকি দিয়ে মামলা করতে বাধা দেন। লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, আমি ও আমার মেয়ে চুয়াডাঙ্গায় এসে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি সে সময় আমার ভাসুরের ছেলে (অভিযুক্ত জাকিরের বড়ভাই) ইসরাফিল হোসেন জমশেদ ও ফুফাতো ভাই পাইকপাড়া গ্রামের লুৎফর রহমানের ছেলে নান্না নতুন করে ষড়যন্ত্রে নেমেছেন। বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছে আমার স্বামী আবুল কাশেমকে ভুল বুঝিয়ে আমাকে অপহরণ করা হয়েছে মর্মে থানায় মিথ্যা মামলা করানো হয়েছে। আমি নিজ ইচ্ছায় জেলা লোকমোর্চা ও আইনজীবীদের কাছে এসেছি। যাদেরকে থানায় অপহরণ মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে তারা নিরপরাধ ও নির্দোষ। আমি আমার মেয়ে ভুন্দি হত্যার বিচার চাই।’

সাংবাদিক সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জেলা লোকমোর্চার সভাপতি অ্যাড. আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন ‘জেলা লোকমোর্চার একটি টিম হাড়োকান্দি গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে জানতে পারে স্কুলছাত্রী ভুন্দিকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যা রহস্য উন্মোচন করার জন্যই আমরা ভুন্দির মাকে আইনি সহায়তা দিতে পাশে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা পুলিশের ভূমিকা রহস্যজনক দেখছি। আমরা আদালতে মামলা দায়েরের মাধ্যমে হত্যারহস্য উন্মোচন করে অপরাধী যেই হোক তার শাস্তি নিশ্চিত করতে চাই। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের শিশু আর ধর্ষণ বা হত্যার শিকার না হয়। এ সময় বক্তব্য রাখেন অ্যাকশন এইডের প্রজেক্টের এলআরপি ম্যানেজর নুঝাত পারভীন, জেলা লোকমোর্চার সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম সনি, সাংগঠনিক সম্পাদক কোহিনুর বেগম, নির্বাহী সদস্য লিটু বিশ্বাস, জুলিয়াস আহমেদ মিল্টু, জীবননগর উপজেলা লোকমোর্চার সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, জেহালা ইউনিয়ন লোকমোর্চার সাধারণ সম্পাদক দেবেন্দ্রনাথ দোবে বাবুলাল ও লোকমোর্চার সচিব শাহানাজ পারভীন শান্তি। চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক সরদার আল আমিনসহ সাংবাদিকবৃন্দ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।