সচিবের নাম ভাঙিয়ে প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক শামীমের পাতা ফাঁদে বহু শিক্ষক

টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় হন্যে হয়ে ঘুরছেন অনেকে ॥ চেকের বিপরীতে টাকা দূরের কথা স্বাক্ষরদানেও ফুটে উঠেছে প্রতারণা
স্টাফ রিপোর্টার: শামীম হোসেন। তিনি চুয়াডাঙ্গা শহরতলী দৌলাতদিয়াড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। কারো কাছে সচিবের খালাতো ভাই, কারো কাছে মন্ত্রির এপিএস’র ঘনিষ্ঠজন সেজে কখনো চাকরি দেয়ার নাম করে, কখনো সুবিধাজনক স্থানে বদলির প্রতিশ্রুতিতে হরহামেশাই হাতিয়ে নিচ্ছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। বাকপটু শামীম হোসেনের লোভনীয় প্রস্তাবে প্রতারিতদের মধ্যে অনেকেই টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় হন্যে হয়ে ঘুরছেন। অ্যাকাউন্টের চেক দিলেও তা ব্যাংক থেকে ফেরত দিচ্ছে। চেকের বিপরীতে শুধু টাকা না থাকার কারণেই নয়, চেকে যে স্বাক্ষর দিচ্ছে তাও ব্যাংকের সাথে মিলিছে না বলে অভিযোগ অনেকের। ইতোমধ্যে কয়েকজন মামলাও করেছেন তার বিরুদ্ধে। এরপরও দিব্যি শিক্ষকতা পেশায় বহাল তিনি।
চুয়াডাঙ্গা বুজরুকগড়গড়ির আব্দুল মতিন ভা-ারদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি বললেন, শামীম হোসেন একজন শিক্ষক। তিনি কি যে অতোবড় টাউট, বুঝিনি। হরিণাকু-ুর একজন নাকি সচিবালয়ের সচিব। ওই সচিব দৌলাতদিয়াড় বাদালপাড়ার আবু তালেব তালুর ছেলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শামীমের নাকি খালাতো ভাই। এ পরিচয় দিয়ে শামীম বললো, সরকরি চাকরি ওয়ান-টু ব্যাপার। টাকা দিলেই চাকরি নিশ্চিত। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওই সচিবের মাধ্যমে আমার ছেলের ব্লক সুপারভাইজার পদে চাকরি দেবে বলে দেড় লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। টাকা নেয়ার কিছুদিন পরই বুঝি ওই শামীম একজন শিক্ষক হয়েও ঠকবাজ। ভাওতা দিয়ে টাকা নিয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কোনো মন্ত্রণালয়ের কোনো সচিবই ওর কিছু হয় না। এরপর যখন টাকা ফেরত চাইতে শুরু করি। তখন সে চেক দেয়। সোনালী ব্যাংকের দেড় লাখ টাকার চেক দিলে চেকের বিপরীতে টাকা না থাকায় এবং স্বাক্ষর মিল না থাকায় চেক ডিজঅনার হয়। এরপর বিধি মোতাবেক উকিল নোটিশ করি। তারও জবাব দেয়নি। ফলে মামলা করা হয়েছে। গত ২৫ মে মামলার দিন ছিলো। ওই দিনে আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়েছে। মামলাটি দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া।
চুয়াডঙ্গা নীলমণিগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজির হোসেন। তিনিও সহকারী শিক্ষক শামীম হোসেনের বিরুদ্ধে আদালতে চেক ডিজঅনার মামলা করেছেন। নজির হোসেন ক্ষোভযুক্ত ঘৃণা প্রকাশ করে বলেন, সচিব মামাতো ভাই। তাকে দিয়ে বদলি করানো কোনো ব্যাপারই নয়। দরকার শুধু টাকা। সুবিধামতো স্থানে বদলির আশায় শামীম হোসেনের হাতে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে দিনের পর দিন ঘুরতে শুরু করি। পরে শুনি শুধু আমি নয়, আমার মতো অনেকেই ওই শামীমের প্রতারণার শিকার হয়ে পথে পথে ঘুরছেন। কেউ দিয়েছে ১০ হাজার, কেউ দিয়েছেন ২৫ হাজার। এদের অধিকাংশের হাতেই শামীমের দেয়া চেক। অল্প টাকার কারণে প্রতারিতদের অধিকাংশই আইনের পথে হাঁটছে না বটে, তবে তারা গাছে বাধার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মানুষের ধৈর্যেরও তো সীমা থাকে?
শামীম হোসেন চুয়াডাঙ্গা দৌলাতদিয়াড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে বদলি হয়ে আসার আগে ছিলেন পীরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তিনি সেখানেও নানা অনিয়ম করেন। পরে অবশ্য টাকা ফেরত দিয়ে পার পেয়েছেন বলে জানা গেলেও শিক্ষকদের অনেকেই বলেছেন, পীরপুর থেকে যখন বদলি হয়ে দৌলাতদিয়াড়ে গেলেন, তখন তিনি দাপটের সাথে বলতে শুরু করেন আমিই শুধু নয়, যেকোনো শিক্ষককে তার পছন্দের বিদ্যালয়ে বদলি করবো চোখের ইশারায়। এ কথায় অনেক শিক্ষকই ওর কাছে টাকা দিয়ে পরে হায় হায় করতে থাকে। শাহাদত হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষক ২৫ হাজার টাকা দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ঘুরে হয়রান। তিনি ওই টাকা ঋণ করে শামীমের হাতে দিয়ে প্রতারিত হন বলে জানিয়েছেন। শুধু কি ওই সহকারী শিক্ষক বা প্রধান শিক্ষকই প্রতারিত হয়েছেন, একজন সহকারী শিক্ষা অফিসারও নগদ ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে এখন লজ্জায় তা ফেরতও চাইতে পারছেন না। সরোজগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নজরুল ইসলাম ১৫ হাজার টাকা দিয়ে যেমন প্রতারিত হয়েছেন বলে জানা গেছে, তেমনই রাঙ্গিয়ারপোতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুস সালামও মোটা অংকের টাকা দিয়ে ভুগছেন মনকষ্টে। ছয়ঘরিয়া সরকাির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী এক শিক্ষকও অল্প কিছু টাকা শামীমকে দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। তিতুদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক একলাস হোসেনও মোটা অংকের টাকা দিয়ে এখন ফেরত পাওয়ার আশায় ঘুরছেন। এ ধরনের প্রতারিত শিক্ষকের সংখ্যা যেমন কম নয়, তেমনই চাকরির প্রত্যাশিত নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেয়াদেরও অনেকে শামীম হোসেনের টোপে পড়ে প্রতারিত হয়ে ঘুরছেন পথে পথে। এদেরই একজন চুয়াডাঙ্গা দৌলাতদিয়াড় উত্তরপাড়ার মারুফ হোসেন। তিনি ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে শামীমের পিছু পিছু ঘুরে যখন বুঝেছেন চাকরি দেয়ার মুরুদ দূরের কথা, সহকর্মীদের বদলিটুকুও করার মতো ন্যূনতম তদবির করা যোগ্যতাও নেই ওর, তখনই টাকা ফেরত তিনে উঠে পড়ে লাগেন। মারুফ হোসেনকেও বেশ ক’টা চেক দিয়েছে শামীম হোসেন।
একের পর এক ব্যক্তির নিকট থেকে টাকা নিয়ে প্রতারণার বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য শামীম হোসেনের মোবাইলফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তা রিসিভ করেননি। মারুফ হোসেনের স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগে চকরি দেয়ার কথা বলে টাকা নিয়ে দিনের পর দিন ঘোরানোর এক পর্যায়ে টাকা ফেরত চাইলে বেশক’টি চেক দেয়। এ বিষয়ে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে ক্ষমা চেয়ে বলেন, ভুল হয়ে গেছে। ওর নিকট থেকে টাকা নেয়া ঠিক হয়নি। যতো দ্রুত সম্ভব টাকা ফেরত দেয়া হবে। এক সপ্তার সময় নিলেও কেটে গেছে কয়েক মাস। এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির এক নেতার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেছেন, ওই শামীম হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। প্রতারিত পাওনাদারদের চাপের মুখে বিদ্যালয়েই ঠিক মতো থাকেন না। সুযোগ বুঝে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করিয়েই সরে পড়েন। গ্রামের ছেলে হওয়ার সুবাদে আর ভুয়া ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দিব্যি চাকরি চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বিষয়টির দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা ও জেলা শিক্ষা অফিসারের আশু দৃষ্টি কামনা করেছেন ভুক্তভোগীরা।