সংলাপ-সমঝোতায় রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ চাইলেন খালেদা জিয়া

সংঘাত হানাহানি ও হিংস তার পথ পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা চাই : আপনি সংবিধানের অভিভাবক আপনাকেই উদ্যোগ নিতে হবে

 

স্টাফ রিপোর্টার: সংঘাত, হানাহানি ও হিংস তার পথ পরিহার করে সরকার যেন অবিলম্বে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতার পথে আসে, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের হস্তক্ষেপ চেয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গতকাল মঙ্গলবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করে দেশ-জাতির ক্রান্তিলগ্নে রাষ্ট্রের অভিভাবক ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে উদ্যোগী হয়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে রাষ্ট্রপতির প্রতি আহ্বান জানান। অন্তত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মহাসচিব পর্যায়ে একটি সংলাপের উদ্যোগের ব্যবস্থা করার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে অনুরোধ জানায় ১৮ দল।

তবে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি তার সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে বলেছেন, তাদের বক্তব্য সম্পর্কে তিনি সরকারকে অবহিত করবেন। অবশ্য রাষ্ট্রপতি এ-ও বলেছেন, সৌজন্যতাবোধ থেকে হলেও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের উচিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের চিঠির জবাব দেয়া। বিষয়টি তিনি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে ব্যক্তিগতভাবে বলবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৮ দলের শীর্ষ নেতাদের সমন্বয়ে ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে প্রায় সাড়ে সাতটা পর্যন্ত এক ঘণ্টা বৈঠক করেন। বৈঠকে ১৮ দলের পক্ষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাষ্ট্রপতির কাছে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ শেষে তা হস্তান্তর করেন। বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে আমরা রাষ্ট্রপতির সাথে কথা বলেছি। আমরা তার কাছে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার বিষয়টি তুলে ধরেছি। রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে এ অচলাবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতার একটি উদ্যোগ নেয়ার জন্য আমরা রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেছি। রাষ্ট্রপতি আমাদের বলেছেন-তিনি তার সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে চেষ্টা করবেন এবং আমাদের বক্তব্য সরকারের কাছে পৌঁছে দেবেন।

বৈঠকে উপস্থিত থাকা ১৮ দলের চারজন নেতার সাথে পৃথকভাবে কথা বলে জানা গেছে, মির্জা ফখরুলের লিখিত বক্তব্য পাঠ শেষে কথাবার্তার এক পর্যায়ে খালেদা জিয়ার উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, আপনারা বলছেন দেশের ক্রান্তিকাল, আমি দেশের অভিভাবক। সংকটে আমাকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানালেন। কিন্তু আপনিও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনিও (শেখ হাসিনা) এখন প্রধানমন্ত্রী, এর আগেও তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আপনারা দু’জনে মিলেই তো সংবিধানে রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতা রাখেননি। ক্রান্তিকালে অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ তো আপনারা কেউই সংবিধানে রাখেননি। সংসদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি যে বক্তব্য রাখি, সেটিও লিখে দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আমি শুধু পাঠক। আমিও চাই, আপনারা নিজেরাই আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করুন।

রাষ্ট্রপতির একথার পর খালেদা জিয়া তাকে বলেন ‘আমরা শান্তি চাই। গণতন্ত্র চাই। সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা চাই। কিন্তু সরকার সকল জনমত উপেক্ষা করে দেশে একদলীয় নির্বাচন করতে চাচ্ছে। সেই নির্বাচনে আমরা অংশ নেব না এবং নির্বাচন করতেও দেবো না।’ জবাবে আবদুল হামিদ বলেন ‘ঠিক আছে, আপনাদের বক্তব্য নিয়ে আমি সরকারের সাথে আলাপ করবো।’

আলোচনার সময় রাষ্ট্রপতিকে মির্জা ফখরুল বলেন ‘আমরা তো সবসময় আলোচনার কথা বলছি। আমি নিজে সৈয়দ আশরাফ সাহেবকে চিঠি পাঠিয়েছি। আজ পর্যন্ত সেই চিঠির জবাবও আমরা পাইনি। এরপর ফোন করেও তাকে অন্তত মহাসচিব পর্যায়ে আলোচনার উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেছি। কিন্তু কিছুতেই সরকারের কোনো সাড়া নেই।’ এ সময় রাষ্ট্রপতি বলেন ‘ঠিক আছে আমি আশরাফ সাহেবকে বলবো, সৌজন্যতাবোধ থেকেও চিঠির জবাব দেয়া উচিত। এ কাজটি আমি করতে পারি।

১৮ দল নেতারা আরও জানান, আলোচনা শেষে বিরোধীদলীয় নেতার উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি বলেন ‘আপনি আসবেন’। জবাবে খালেদা জিয়া তাকে বলেন ‘আপনি ডাকলে আসবো।’ এরপর রাষ্ট্রপতি বলেন ‘আমি তো ভয়ে আপনাকে ডাকি না, ডাকলে যদি না আসেন’।

এদিকে রাষ্ট্রপতির কাছে দেয়া লিখিত বক্তব্যে মির্জা ফখরুল বলেছেন, জাতীয় জীবনে আজ এক সন্ধিক্ষণ। দেশ আজ এক গভীর সংকটে। অবাধ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং সকল দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হবে কি-না গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে কি-না সেটাই আজ এক জ্বলন্ত প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকারের নামে মহাজোটের সদস্যদের নিয়েই মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করে সংকটকে আরো তীব্রতর করা হয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ধারায় আপনি কোনো আগন্তুক নন। একজন সক্রিয় রাজনীতিবিদ, অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও স্পিকার হিসাবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সমকালীন রাজনীতিতে আপনি কার্যকর ভূমিকা রেখে এসেছেন। আমরা তাই, রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসাবে আজ আপনার কাছে এসেছি। আপনার কাছে আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ, আপনি সরকারকে বলুন, তারা যেন সংলাপের একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করে। তারা যেন অবিলম্বে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে একটি সমঝোতার পথে অগ্রসর হয়।

রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে ১৮ দলের মির্জা মুখপাত্র ফখরুল বলেন, প্রজাতন্ত্রের সংবিধান থেকে উত্সারিত আপনার ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমরা সচেতন রয়েছি। কিন্তু কখনো কখনো এমন পরিস্থিতি আসে, যখন রাজনীতিকদের হাতে প্রণীত এবং সংকীর্ণ স্বার্থে রদবদলকৃত সংবিধানের ধারা-উপধারা জনগণের আশা-আকাঙ্খার সাথে সংগতিপূর্ণ থাকে না। তখন তা সংকট নিরসনের পথ-নির্দশনা দিতে সক্ষম হয় না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণের প্রত্যাশাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সংবিধানকে পুনর্বিন্যস্ত করতে হয়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিকেও তখন ইতিহাস-নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমরা মনে করি আজ জাতীয় জীবনে তেমনই একটি সময় এসেছে। দেশ-জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে জনগণের ঐক্যের প্রতীক হিসাবে আপনি নিজে উদ্যোগী হয়ে তেমনই একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবেন, দেশবাসীর সেটাই প্রত্যাশা। আমরাও সেই আশাই করি।

রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে ১৮ দলের পক্ষে আরও বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রহিত করে দেশকে এক চরম অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে। পদত্যাগী মন্ত্রীদের দিয়ে দায়িত্ব পালন, মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠান এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে সরকার ইতোমধ্যেই প্রজাতন্ত্রের সংবিধান গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করেছে। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের সামান্যতম কোনো সুযোগ নেই। সরকার দেশে প্রায় জরুরি অবস্থার মত এক অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বাভাবিকভাবে কাজ-কর্ম পরিচালনা করতে দেয়া হচ্ছে না। বিরোধীদলের সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন কার্যালয় প্রায় নিয়মিত অবরোধ করে রাখা হচ্ছে। বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে সংলাপের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।

পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়ার কোনো আহ্বান জানাননি রাষ্ট্রপতি: বৈঠককালে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বিরোধীদলকে পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভায় যোগদানের জন্য কোনো আহ্বান জানাননি। বঙ্গভবনে বৈঠকের পর রাতে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে একথা জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি এটাও জানান, রাষ্ট্রপতির সাথে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার একান্তে কোনো কথা হয়নি। মির্জা ফখরুল বলেন, এখন আর কোনো বিকল্প না থাকায় তারা রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। গণতন্ত্র যাতে বিপন্ন না হয়, সেজন্য সরকার ও বিরোধী দলকে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান বের করার আহ্বান জানিয়েছেন। উদ্যোগের জন্য রাষ্ট্রপতিকে কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে কি-না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কোনো সময়সীমা দেয়া হয়নি। বিএনপি দেখবে, এরপর রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।