শৈলকুপায় মাকে খুনের পর ছেলেকে কুপিয়ে আহত

ছেলের পিতৃপরিচয়ের স্বীকৃতি চাওয়ায়

 

ঝিনাইদহ অফিস: ছেলের পিতৃপরিচয়ের স্বীকৃতি চেয়ে সংবাদ সম্মেলনের একদিন পরেই ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলায় এক নারীকে বাড়ি থেকে ধরে এনে নির্যাতন ও শ্বাসরোধে হত্যা এবং তার ছেলেকে কুপিয়ে আহত করেছে দুর্বৃত্তরা। গত সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে নিত্যানন্দপুর ইউনিয়নের বাগুটিয়া এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। নিহত সাজেদা খাতুন সাজু (৪৮) বাগুটিয়া গ্রামে মৃত খোরশেদ মোল্লার মেয়ে। তিনি পিতার বাড়িতে থাকতেন।

এলাকাবাসী ও শৈলকুপা থানার এসআই এমদাদ হোসেন জানান, রাতে মা ও ছেলে বাড়িতে ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ১০/১২ জনের একদল দুর্বৃত্ত বাড়িতে ঢুকে মা ছেলেকে চোখ মুখ বেঁধে ফেলে। তারপর অপহরণ করে নিয়ে যেতে থাকে। গ্রামের লোকজন টের পেয়ে চিৎকার শুরু করে। ছেলে জিন্নাহ আলমকে (৩০) কুপিয়ে মারাত্মক আহত করে পরিতোষ চৌকিদারের বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে যায়। রাতে মাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। গ্রামবাসী ছেলেকে উদ্ধার করে রাতেই শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্র্তি করে। অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। গতকাল মঙ্গলবার সকালে গ্রামের মাঠে সাহেব আলী বিশ্বাসের কলাক্ষেতের ভেতর সাজেদা খাতুনের লাশ পাওয়া যায়। তাকে শ্বাসরোধ ও নির্যাতনে হত্যার পর কলাগাছের সাথে পিছমোড়া করে বেঁধে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা। পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালমর্গে পাঠিয়েছে।

এদিকে এই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে, শৈলকুপা উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আবাইপুর ইউপির চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে। ছেলের পিতৃপরিচয়ের স্বীকৃতির দাবি করে গত রোববার ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন সাজেদা। তিনি শৈলকুপা উপজেলার হাট ফাজিলপুর গ্রামের বাসিন্দা বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলামকে নিজের স্বামী ও ছেলের পিতা বলে দাবি করেন। নিহতের ছেলে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জিন্নাহ আলম অভিযোগ করেন, সংবাদ সম্মেলন করার কারণে রফিকুল ইসলাম ও তার লোকজন তাদের হুমকি দিয়ে আসছিলেন। এর জের ধরে রফিকুল ইসলাম ও তার লোকজন এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন।

নিহত সাজেদা খাতুনের ভাই আমির আলী জানান, ১৯৮৩ সালে বিএনপি নেতা রফিকুল আলমের সাথে সাজেদা খাতুনের বিয়ে হয়। পরে সাজেদা খাতুন জানতে পারেন রফিকুলের আগে বিয়ে হয়েছে। সব কিছু জেনেই গোপনে তারা সংসার করেন। ৮৪ সালে তার ছেলে জিন্নাহর জন্ম হলে রফিকুল টালবাহানা শুরু করেন। ৮৫ সালে রফিকুলের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন সাজেদা। পরে মেনে নেয়ার কথা বললে রফিকুলের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেন সাজেদা। কিন্তু ৩১ বছর ধরে রফিকুল তার দ্বিতীয় স্ত্রী সাজেদা ও ছেলে জিন্নাহকে সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। এমনকি রফিকুল স্ত্রী ও সন্তানের কোনো স্বীকৃতি দিচ্ছেন না। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এ ঘটনাটি কয়েকবার মীমাংসারও চেষ্টা করেছেন। এ ব্যাপারে কোনো সমাধান না হওয়ায় সাজেদা খাতুন সাজু ও তার ছেলে আদালতে মামলা করেন। এই সংবাদ সম্মেলন করার একদিন পর সোমবার রাতে সাজেদা নিজের পিতার বাড়িতে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হলেন। খুন হওয়া সাজেদা ভিক্ষাবৃত্তিসহ মানুষের বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

এ ব্যাপারে শৈলকুপার নিত্যানন্দপুর ইউপি চেয়ারম্যান মফিজ উদ্দিন বিশ্বাস বলেন, নিহত সাজিদা এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামকে স্বামী হিসেবে দাবি করে আসছিলেন। এ ঘটনা নিয়ে এলাকার সামাজিক প্রতিপক্ষ সাজেদাকে ইন্ধন দিয়ে সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করায়। সাজিদা স্বামী দাবি করার পক্ষে চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রদত্ত নাগরিক, প্রত্যায়নপত্র ও যে জন্ম সনদ দাখিল করেছেন তাতে আমি স্বাক্ষর করিনি। আমার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।

আবাইপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাকে ফাঁসানোর জন্য প্রতিপক্ষরা সুপরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। স্ত্রী-সন্তানকে বঞ্চিত করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাজেদা আমার স্ত্রী নয়। সুতরাং জিন্নাহ আমার সন্তান হবে কী করে। স্ত্রী-সন্তান না হলে অধিকারের প্রশ্নই ওঠে না। তিনি দাবি করেন গত রোববার যারা সাজেদাকে নিয়ে ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছিল তারাই তাকে হত্যা করেছে।

প্রসঙ্গত, ২৮ সেপ্টেম্বর গত রোববার ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবে এলাকার সামাজিক দলের নেতা মুক্তার মৃধার লোকজন সাজেদাকে সাথে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে অ্যাডভোকেট সুমন মৃধা, ইকবাল হোসেন মেম্বার, রবিউল ইসলাম, আবু বকর বিশ্বাস, আব্দুর রাজ্জাক ও শহিদুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

শৈলকুপা থানার ওসি ছগির মিঞা জানান, সামাজিক বিরোধ ও দলাদলির কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। পুলিশ এখনও কাউকে আটক করেনি।