শৈলকুপায় ইলা মিত্রের পৈতৃক বাড়ি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার

 

শাহনেওয়াজ খান সুমন: অবশেষে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের পৈতৃক ভিটাবাড়ি। ঝিনাইদহের শৈলকুপার বাগুটিয়া গ্রামে রয়েছে নানা কারুকার্যখচিত তাদের ঐতিহ্যবাহী দ্বিতল বাড়ি। এছাড়াও রয়েছে কয়েকশ বিঘা জমি, যার সবটুকুই বেদখল হয়ে গেছে। এলাকার মানুষসহ দেশবাসীর কাছে প্রায় অজানা ছিলো এ বাড়ির ইতিহাস। দৈনিক মাথাভাঙ্গাসহ গণমাধ্যমে গত ৫ বছর ধরে এ বাড়িটি দখলমুক্তকরণ ও সংরক্ষণের ব্যাপারে নানা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

কিন্তু সরকারসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় সংগ্রামী এ নারীর পৈতৃক ভিটাবাড়িটি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টনক নড়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। বাড়িটির সংরক্ষণ বিজ্ঞপ্তি জারির জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসককে। সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষে উপসচিব মো. মকবুল হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার বাগুটিয়া (রায়পাড়া) গ্রামের ইলা মিত্রের পৈতৃক বাড়িটি প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৬৮ সালের (সংশোধিত ১৯৭৬) পুরাকীর্তি আইনে সংরক্ষণ উপযোগী। শৈলকুপা থেকে দক্ষিণে ১৩ কিলোমিটার দূরে বাগুটিয়া রায়পাড়াতে কাঁচা রাস্তার পাশে রয়েছে চুন-সুড়কি দিয়ে গাঁথা ৯ রুমের পুরাতন একটি দ্বিতল বাড়ি।

ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজো সেই বাড়িটি দাঁড়িয়ে থাকলেও রয়েছে বেদখল, রয়েছে শুধু কাগজে-কলমে। ভেঙে ফেলা হয়েছে ইটের গাঁথুনি ও ভিতগুলো। চওড়া দেয়ালে ঘেরা পাঁচিলের অনেক অংশ ভেঙে ফেলেছে দখলদাররা। শুধু বাড়ি নয়, দখল করা হয়েছে ইলা মিত্রের বাবা নগেন্দ্রনাথ সেনের রেখে যাওয়া শ শ বিঘা জমি। সরকারের খাতায় এগুলো ভিপি তালিকাভুক্ত হলেও বাস্তবে এলাকার প্রভাবশালীদের দখলে। এলাকাবাসী জানতেন এই বাড়িটি হিন্দু সম্প্রদায়ের কারো ছিলো, বর্তমানে হাজি কিয়াম উদ্দিনের ছেলেরা বসবাস করেন। বাগুটিয়া গ্রামের ১১৬নং মৌজার ২৩৪৫ দাগের জমির ওপর বাড়িটি যে তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী, সংগ্রামী নারী, নাচোলের রানী ইলা মিত্রের পৈতৃক ভিটাবাড়ি, সে ইতিহাস প্রায় সবার কাছে অজানা রয়েছে।

বর্তমানে বাড়িতে বসবাস করছেন হাজি কিয়াম উদ্দিনের তিন সন্তানআলী হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম ও আব্দুর রশিদ। তারা বাড়িসহ ৮৪ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন বলে দাবি করে আসছে। ইলা মিত্র কিংবদন্তি নারী। বাবা নগেন্দ্রনাথ সেনের চাকরির সুবাদে ইলা সেনের জন্ম কোলকাতায়। ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন বেঙ্গলের ডেপুটি একাউন্টেন্ট জেনারেল। মা মনোরমা সেন গৃহিণী। ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রাম তাদের পৈতৃক নিবাস। ইলা মিত্রের জন্ম কোলকাতায় হলেও ছোটবেলায় তিনি বেশ কয়েকবার বাগুটিয়া গ্রামে এসেছেন। ১৯৪৫ সালে চাপাইনবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুরের জমিদার বাড়ির রমেন্দ্রনাথ মিত্রের সঙ্গে ইলা সেনের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার নাম হয় ইলা মিত্র।

ইলা মিত্রের রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে জানা যায়, ১৯৪৩ সাল থেকে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চাপাইনবাবগঞ্জের নাচোল অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এই আন্দোলনের সময় তার ওপর পুলিশের অমানবিক নির্যাতন চলে। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি কারাগার থেকে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে কোলকাতায় চলে যান। এরপর তিনি কোলকাতার বিভিন্ন রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তিনি কোলকাতার মানিকতলা নির্বাচনী এলাকা থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন। কর্মজীবনে তিনি কলকাতা সিটি কলেজের বাংলা সাহিত্যে অধ্যাপিকা হিসেবে ১৯৮৯ সালে অবসর নেন। ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর এই মহিয়সী নারী কোলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

কিংবদন্তি নারী ইলার শৈশব-কৈশর সময় পার করা শৈলকুপার বাগুটিয়া, গোপালপুর, শেখরা, রঘুনন্দপুর, শাহাবাজপুরসহ কয়েকটি গ্রামে রয়েছে কয়েকশ বিঘা জমি। তার বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন, মা মনোরমা সেন, দাদা রাজমোহন সেনের নামে রয়েছে এসব জমি। মূলবাড়িসহ বেশিরভাগ জমি ১৯৬৫ সালে ভিপি সম্পত্তি হিসেবে সরকারি খাতায় থাকলেও তার সবটুকুই এখন বেদখল। তবে ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা জানান এসব সম্পত্তির ব্যাপারে সেটেলমেন্ট অফিসে আপত্তি ও দু শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে। এছাড়া মূল বাড়িটি দুদেশের হাইকমিশনের মাধ্যমে বিনিময় হয়েছিলো বলে ভূমি কর্মকর্তাদের কাছে কিছু কাগজপত্র জমা দিয়েছে দখলদাররা।

ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক শফিকুল ইসলাম দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে জানান, ইলা মিত্রের বাড়িটি সংরক্ষণ বিজ্ঞপ্তি জারির নিমিত্তে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চিঠি পাওয়া গেছে। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী ইলা মিত্রের পৈতৃক ভিটা বাড়ির দাগ, খতিয়ান, জমির পরিমাণ ও দখলদারদের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই চলছে। তিনি বলেন, এটি সংরক্ষণ করা হলে দর্শনাথীদের জন্য পর্যটন স্থান হতে পারে, রক্ষা পাবে বাড়িটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব।