শিক্ষক এমপিওভুক্তিতে দুই কারণে অনিয়ম : দুর্নীতি রোধে ৪০ সদস্যের ২০টিম

স্টাফ রিপোর্টার: ‘বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যত দ্রুত এমপিওভুক্তি হওয়া যাবে, বেতন ভাতাও মিলবে ততো দ্রুত। যদি বেতন ২২ হাজার টাকা হয়, আর এমপিওভুক্ত হতে এক বছর বিলম্ব হয় তবে শিক্ষক বঞ্চিত হবেন ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা থেকে। এ কারণে এমপিওভুক্তির জন্য ৬০ হাজার বা এক লাখ টাকা খরচ করলে তো তেমন কোনো ক্ষতি নেই।’

টাকার বিনিময়ে এমপিওভুক্ত হওয়া এক শিক্ষকের এমন জবাবই এমপিওভুক্তিতে ঘুষ লেনদের কারণ স্পষ্ট। তবে যে সব কর্মকর্তা এমপিওভুক্তির কাজ করেন শিক্ষকদের এই ধারণা সম্পর্কে তারাও জানেন। এ জন্য তারা কারণে, অকারণে এমপিওভুক্তিতে বিলম্ব করেন, হয়রানি করেন যাতে শিক্ষকরা অনৈতিক অর্থ লেনদেনে বাধ্য হন।

আমিরুল ইসলাম নামে এক শিক্ষক বলেন, অবস্থার শিকার হয়ে ঘুষ দিতে হয়। কাজটা যাতে তাড়াতাড়ি হয় এজন্য শিক্ষকরা ঘুষ দিয়ে থাকেন। কারণ একজন স্কুল শিক্ষকের এমপিও’র ফাইল যদি ৬ মাস আটকে থাকে তা হলে তিনি প্রায় ৯৬ হাজার টাকা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। এছাড়া অনেক শিক্ষক এমপিওভুক্ত পাওয়ার যোগ্য না হলেও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনৈতিকভাবে সুবিধা দিয়ে এমপিও ভাগিয়ে নিচ্ছেন।

২০১৫ সালে শিক্ষকদের এমপিও (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার বা বেতন-ভাতার সরকারি অংশ) বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরের হাতে থাকা এই এমপিও ৯টি আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ে ভাগ করে দেয়া হয়। লক্ষ্য ছিলো দুর্নীতি রোধ করা। কিন্তু সে লক্ষ্যতো পূরণ হয়নি বরং শিক্ষকদের হয়রানি কয়েকগুণ বেড়েছে। বিজ্ঞান ও কম্পিউটার বিষয়ের অনুমোদন না থাকার পরও জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার একটি স্কুল থেকে সম্প্রতি দুজন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হয়েছেন। ভৈরব উপজেলার একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ে এমপিও পেয়েছেন একজন। অতিরিক্ত শ্রেণি শাখার আওতায় দুই বছর এমপিও না পাওয়ার শর্তে নিয়োগ দেয়া হলেও নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তিনি এমপিও পেয়েছেন। অভিযোগ, এ ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেন হয়েছে। আবার জামালপুর জেলার বকশিগঞ্জ উপজেলার একটি মাদারসার ‘বিজ্ঞান’ বিষয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে এমপিও পেয়েছেন যার নিবন্ধন গণিত বিষয়ের। অভিযোগ, যোগ্যতা না থাকার পরও ঘুষের বিনিময়ে এরা এমপিওভুক্ত হয়েছেন।

ময়মনসিংহ সদরের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (বিজ্ঞান) পদে ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পান এক শিক্ষক। তিনি তার এমপিওভুক্তির জন্য সব স্তর শেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) ময়মনসিংহ আঞ্চলিক উপ-পরিচালকের কার্যালয়ে আসেন। তবে উপ-পরিচালক দেড় বছর ধরে এই শিক্ষককে হয়রানি করছেন এমন অভিযোগ এসেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও। নানা অজুহাতে তিনি কালক্ষেপণ করেন। সময়ক্ষেপণ করার জন্য তিনি মাউশির মহাপরিচালককে চিঠি দিয়ে জানতে চান, ওই শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করা যায় কি-না?  জবাবে মাউশি এমপিওভুক্তির নির্দেশ দেয়। যাতে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায় এবং আর্থিক সুবিধা বঞ্চিত হন ওই শিক্ষক।

অনিয়মে যারা জড়িত: ৪ থেকে ৫ স্তরের কর্মকর্তারা দুর্নীতির সাথে জড়িত যার বেশিরভাগই মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা। প্রথমে স্কুল থেকে এপিওভুক্তির জন্য প্রধান শিক্ষককে ম্যানেজ করতে হয় ঘুষ দিয়ে। এরপর উপজেলা শিক্ষা অফিসার, সেখান থেকে জেলা শিক্ষা অফিসারকে ঘুষ দিতে হয়। উপ-পরিচালক পর্যন্ত এই অনৈতিক সুবিধা দিতে হয়। দিলেই অনলাইন ফাইলে সঠিক মন্তব্য করা হয়, নয়তো নানা কারণ দেখিয়ে তা বাতিল করা হয়। নতুন এমপিওর ক্ষেত্রে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে পদ সৃষ্টি করতে ঘুষ দিতে হয় কয়েক হাজার টাকা। প্রতি স্তরে ঘুষ দিতে হয় ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এতে প্রতি শিক্ষকের এমপিওতে মোট ঘুষ দিতে হয় ৫০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত।

ক্ষুব্ধ শিক্ষামন্ত্রীও: এমপিওভুক্তির এ অনিয়ম এবং হয়রানি সম্পর্কে জেনে ক্ষুব্ধ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও। একাধিক মাধ্যমে এ অনিয়ম এবং দুর্নীতির প্রমাণও পেয়েছেন তিনি। দুর্নীতি কারা করছেন তা ধরতে মাঠে ২০টি টিম করার কথা জানান শিক্ষামন্ত্রী।

তিনি জানান, আমি এমপিওভুক্তির অনিয়মে অসন্তুষ্ট। যারা এসব অনিয়মে জড়িত তারা মাঠ পর্যায় হোক বা শিক্ষা অধিদফতরের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা হোক কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এভাবে অনিয়ম দুর্নীতি চলতে পারে না। এমপিওভুক্তি নিয়ে মন্ত্রীর নির্দেশনার পরই অনিয়ম ধরতে ৪০ সদস্যের তদন্ত দল গঠন করা হয়। এই ৪০ জন ২০টি টিমে কাজ করবেন। এই টিমের অধিকাংশই বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত সরকারি কলেজের শিক্ষক। তারা সবাই মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত।

চলতি সপ্তাহে এমপিওভুক্তি নিয়ে শিক্ষা কর্মকর্তাদের সাথে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিক্ষামন্ত্রী। এ সময় মাউশির এক পরিচালক মন্ত্রীকে বলেন, ‘অনলাইনে এমপিওতে মাঠপর্যায়ে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে। উপজেলা, জেলা ও উপ-পরিচালকের দফতরে দুর্নীতি হচ্ছে। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের কাছে শিক্ষকরা গেলে আগে কেরানির সাথে দেখা করতে বলেন। কেরানি সিগন্যাল দিলেই ফাইল ছাড়েন। একই অবস্থা উপ-পরিচালকের কার্যালয়েও। আসলে এমপিও বিকেন্দ্রীকরণে দুর্নীতি বহু গুণ বেড়েছে। আমরা এর একটা সমাধান চাই।’