শিক্ষক আন্দোলনে দেড় কোটি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত

স্টাফ রিপোর্টার: এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনে দেশের মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থীর পড়ালেখায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এরই মধ্যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষাবিদদের আশঙ্কা, এ সঙ্কট দ্রুত সামাল দেয়া না গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আর শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া মেনে নিতে হলে সরকারকে প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হবে। যা জোগান দেয়াও সরকারের পক্ষে সত্যিকার অর্থেই কষ্টকর। তাই এ ইস্যুতে সরকার গাছাড়া ভাব দেখিয়ে নানা কৌশলে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ঘরে ফেরানোর চেষ্টা করছে।
তবে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্দোলনরত শিক্ষকদের দাবি মেনে না নিয়ে যে কোনোভাবে তাদের কর্মস্থলে ফেরত পাঠানো হলেও উত্তপ্ত পরিস্থিতি শীতল হতে বেশখানিকটা সময় লাগবে। পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে পাঠ্যদানেও শিক্ষকরা অমনোযোগী হবেন। শিক্ষাব্যবস্থার অন্যান্য কার্যক্রমও তারা দায়সারাভাবে চালাবেন।
এদিকে আন্দোলনরত শিক্ষকরাও তাদের চাপা ক্ষোভ এবার সরাসরিই প্রকাশ করছেন। তারা জানিয়েছেন, স্বল্প বেতন উচ্চমূল্যের এ বাজারে টিকে থাকা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তাই নানাভাবে বঞ্চিত ও অবমূল্যায়িত হয়ে তাদের পক্ষে কর্মস্থলে মনোযোগী হওয়া সম্ভব নয়। সমাজে অমর্যাদাকর অবস্থানও তাদের নানাভাবে পীড়া দিচ্ছে বলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, স্বল্প সংখ্যক শিক্ষক সরাসরি আন্দোলনে অংশ নিলেও এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবির সঙ্গে ১৯ হাজার ২৩৩টি মাধ্যমিক স্কুলের ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫৩ জন শিক্ষক সম্পৃক্ত। পাশাপাশি ৪ হাজার ৭টি কলেজের ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৩৭ শিক্ষক; ৯ হাজার ৮৯৭টি মাদরাসার ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৬৮ শিক্ষক এবং ৫ হাজার ৮৯৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩২ হাজার ৩৭৯ জন শিক্ষক চলমান আন্দোলনে জড়িত। যদিও তারা সবাই এখনই একসঙ্গে সরাসরি আন্দোলনে যোগ না দিয়ে পালাক্রমে অংশ নিচ্ছেন। তবে সরকার শিগগিরই তাদের দাবি মেনে না নিলে সবাই একযোগে রাজপথে নামবেন- এমন প্রস্তুতিও চলছে।
বেসরকারি শিক্ষা জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফোরামের যুগ্ম-আহ্বায়ক মতিউর রহমান বলেন, এই আন্দোলনে যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক ঢাকায় আসছেন। প্রয়োজনে সবাই কর্মস্থল ছেড়ে ঢাকায় আসবেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দাবি পূরণের ঘোষণা না আসা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে বলে দাবি করেন তিনি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে জড়িত মাধ্যমিক স্কুলে ৯১ লাখ ৬০ হাজার ৩৬৫ জন, কলেজ পর্যায়ে ৩৭ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮৪ জন, মাদরাসা পর্যায়ে ২৪ লাখ ৬০ হাজার ৩০৫ জন এবং কারিগরিতে ৮ লাখ ৭৫ হাজার ২৭০ জন শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত। শিক্ষকদের হুমকি-ধামকিকে সরকার ততটা গুরুত্ব না দিলেও এ নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। তাদের ভাষ্য, এমনিতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কোচিং বাণিজ্য ও গাইডবইয়ে গণ্ডিবদ্ধ। এর ওপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদানে নতুন করে বিঘ্ন সৃষ্টি হলে তাতে হ-য-ব-র-ল অবস্থায় সৃষ্টি হবে।
শিক্ষকদের আন্দোলনের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, শিক্ষকদের কাজ ক্লাসে থাকা, শিক্ষার্থীদের পড়ানো। কিন্তু তারা যখন দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছ থেকে বেতন-ভাতা না পান, তখন পেশাদারিত্ব নষ্ট হয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করানোর মনোভাব তাদের থাকে না।
তিনি বলেন, বাস্তবতা হলো- একই দেশে একই পেশায় একজন শিক্ষক বেতন পাচ্ছেন, অন্যজন পাচ্ছেন না, অথচ দুজনই শিক্ষার্থীকে পড়ান। এটা অনুচিত, মানা কঠিন। সরকার একদলকে বেতন দেবেন, অন্য দলকে দেবেন না, এটা হতে পারে না।
এ অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনা তো হবেই না, সেই সঙ্গে বিশাল অংকের কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীরা সুদূরপ্রসারী সমস্যায় পড়বে। তারা চান যত দ্রুত সম্ভব এ সব সমস্যার মোকাবেলা করা এবং সরকারের পক্ষ থেকেই এই উদ্যোগ আসতে হবে।
এ ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, প্রাথমিক স্কুল বা মাদরাসা পর্যায়ে ডিসেম্বর, জানুয়ারি মাসে ক্লাসের সংখ্যা কম থাকে। কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস ও পরীক্ষা থাকে। ক্লাস থাক বা না থাক শিক্ষকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না থাকলে দীর্ঘমেয়াদে তার নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থার ওপর পড়ে। এ সব দাবি-দাওয়ার মধ্যে গ্রহণযোগ্য বিষয়গুলোকে দ্রুত মেনে নেয়া উচিত। এবং অগ্রহণযোগ্যগুলোর বিষয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে তাদের বুঝানো উচিত।
তিনি আরও বলেন, এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা উচিত নয়, যার ফল শিক্ষার্থীদের ভোগ করতে হয়। সরকার ও শিক্ষক উভয় কর্তৃপক্ষকে বুঝতে হবে- এ ধরনের আন্দোলনের ফলে দেশ পিছিয়ে যাবে। এ কারণে বিষয়টিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। মিজানুর রহমান মনে করেন, নির্বাচনী বছরে এ ধরনের বিষয় সামনে আসবেই। কিন্তু সরকারের বিচক্ষণ নেতৃত্ব ও যথাযথ সিদ্ধান্তের কারণে গার্মেন্টস খাতের সঠিক সময়ে বেতন বাড়িয়ে আন্দোলন রোধ করা গেছে। অন্যান্য বিষয়েও আগেভাগে ব্যবস্থা নিলে তা সবদিক থেকেই সরকারের অনুকূলে থাকবে বলে মত দেন তিনি।
টাঙ্গাইলের নাগরপুর মুক্তিযোদ্ধা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, তারা একই এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট ৪৬ জন শিক্ষক সরাসরি আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। পালাক্রমে অন্য শিক্ষকরা ঢাকায় আসার পর তারা কর্মস্থলে ফিরে যাবেন। তবে সরকার সহসা তাদের দাবি মেনে না নিলে পাঠদান কর্মসূচি পুরোপুরি বন্ধ করে সবাই একযোগে আন্দোলনে নামবেন।
আন্দোলনে যোগ দিতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক ঢাকায় চলে আসায় সেখানকার স্কুলের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় কোনো ব্যাঘাত ঘটছে কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘তা তো অবশ্যই হচ্ছে। যদিও আমরা এখনো সবকিছু স্বাভাবিক রেখেই আন্দোলন চালানোর চেষ্টা করছি। তবে দাবি মেনে না নিয়ে কোনো কৌশলে এ আন্দোলন পন্ড করে দেয়া হলে তার ফল আরও বেশি খারাপ হবে।’
কুমিল্লার মুরাদনগরের হায়দারাবাদ বেগম জাহানারা হক ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক মো. লোকমান হোসেন বলেন, তাদের ২৯ জন শিক্ষকের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৬ জন রাজপথের আন্দোলনে সরাসরি যোগ দিয়েছেন। বাকিরা পালাক্রমে ঢাকায় আসার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। শিক্ষকরা পালাক্রমে আন্দোলনে যোগ দেয়ায় পাঠ্যকার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ না হলেও নতুন বছরের শুরুতে এ ধাক্কা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা যথেষ্ট বিঘ্নিত হবে বলে নিঃসংকোচে স্বীকার করেন এই শিক্ষক।
এদিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় অবস্থানরত এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের সংখ্যা তেমন বেশি না হলেও দেশের অধিকাংশ স্কুল-কলেজে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক অনুপস্থিত রয়েছেন। এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষকদের অনেকে আন্দোলনে যোগ দেয়ার কথা বলে ঢাকায় এলেও আত্মীয়-স্বজনের বাসায় অবস্থান করছেন। কেউ কেউ মাঝে মধ্যে প্রেসক্লাবের সামনে এসে ঢুঁ মেরে যাচ্ছেন। আন্দোলনরত শিক্ষকরাও এ বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
কুমিল্লার মেঘনার চন্দনপুর এম এ উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক এমদাদুল হক শেখ জানান, এলাকা থেকে তারা গাড়ি ভরে ঢাকায় এসেছেন। অথচ অনেকে মাত্র দু’একঘণ্টার জন্য প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন। বাকি সময় তারা অন্য কোথাও সময় কাটাচ্ছেন। আন্দোলনের উদ্দেশ্যে কর্মস্থল ছেড়ে আসা শিক্ষকরা একসঙ্গে রাজপথে অবস্থান নিলে শুধু জাতীয় প্রেসক্লাব নয়, এর আশপাশের পুরো এলাকাই অচল হয়ে যেত বলে মন্তব্য করেন তিনি।