শান্তিরক্ষায় আন্তর্জাতিক সুনাম এসেছে

আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

 

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর শান্তিরক্ষীদের বিশ্বব্যাপী শান্তিক্ষা কার্যক্রমে দেশের ভাবমূর্তি বজায় রেখে পেশাদারিত্ব, সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মিশনগুলোতে শান্তিরক্ষীরা যাতে আরও দক্ষতা ও কার্যকরীভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন সে লক্ষে সেনাবাহিনী ও পুলিশকে আপগ্রেড করতে সরকারি অঙ্গীকারের কথা পুনরুল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জামসহ বাংলাদেশের সব শান্তিরক্ষী যাতে আরও আত্মবিশ্বাসের সাথে জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিতে পারে, সে জন্য সরকারের সব প্রয়াস অব্যাহত থাকবে। বিশ্ববাসীর পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় শান্তিরক্ষীদের ভূমিকা চিরকাল স্মরণ রাখবে।

প্রধানমন্ত্রী গতকাল রোববার সকালে নগরীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী দিবস উপলক্ষে ঢাকার জাতিসংঘ অফিসের সহায়তায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনী এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

এতে আরও বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া, ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রবার্ট ওয়াটকিনস। চিফ অব নেভাল স্টাফ ভাইস এডমিরাল এম ফরিদ হাবিব, চিফ অব এয়ার স্টাফ এয়ার মার্শাল মুহাম্মদ ইনামুল বারী, সেনাবাহিনীর আর্মড ফোর্স বিভাগের প্রিন্সিপাল অফিসার লে. জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ সাইফুল হক, পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক এবং ভারপ্রাপ্ত আইজিপি জাভেদ পাটোয়ারী এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে মন্ত্রীরা, উপদেষ্টারা, সংসদ সদস্য, বিদেশি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীর সাবেক শান্তিরক্ষী, নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী পরে মালি ও কঙ্গোতে দায়িত্বরত শান্তিরক্ষীদের কার্যক্রম নিয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তাদের সাথে মতবিনিময় করেন। এর আগে বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষীর দায়িত্ব পালনকালে এবং সন্ত্রাসীদের আক্রমণে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের কার্যক্রমের ওপর নির্মিত একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।

এ ঐতিহ্যবাহী দিনটি সুন্দরভাবে উদযাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, আপনারা বাংলাদেশকে বিশ্বে একটি শাক্তিশালী শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবেন এবং বিশ্বে বাংলাদেশের পতাকাকে সমুন্নত রাখবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা। প্রধানমন্ত্রী এ বিশেষ দিনে শহীদ শান্তিরক্ষী, যারা বিশ্বশান্তি স্থাপনের জন্য কাজ করতে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি শান্তিরক্ষীদের, যারা বিশ্বশান্তি স্থাপনের মতো গুরুদায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তিনি বলেন, আপনারা পেশাদারিত্ব, দক্ষতা ও নিষ্ঠা প্রদর্শন করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে ওইসব দেশের জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন। জীবনের ওপর ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আপনারা উন্নত দক্ষতার পরিচয় দিয়ে দেশের জন্য সর্বদা প্রশংসা বয়ে এনেছেন। জাতিসংঘ এবং বিশ্বের সব শান্তিপ্রিয় দেশ আপনাদের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের সাফল্যের জন্য অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছে। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বে প্রথমসারির শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে যে গৌরব ও মর্যাদা লাভ করেছে, তা আপনাদের সাহস, বীরত্ব, অসামান্য পেশাদারিত্ব ও দক্ষতায় অর্জিত ফসল। দেশের সব নাগরিকের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ এবং উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বাংলায় প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণে বিশ্বের সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অব্যাহত সমর্থনের বিষয়ে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি অত্যন্ত জরুরি এবং তা সমগ্র বিশ্বের নর-নারীর গভীর আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে এবং ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত শান্তিই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।’ সে থেকেই বাংলাদেশ বিশ্বের শান্তিপ্রিয় ও বন্ধুপ্রতিম সব দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের অধীনে পরিচালিত সব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। তিনি বলেন, সমগ্র বিশ্বে আজ শান্তিরক্ষায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বজনবিদিত। যা নিশ্চিতভাবে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সফল অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ১২২টি দেশের ১ লাখ ৭ হাজার ৮শ ৫ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত রয়েছেন। তার মধ্যে বাংলাদেশেরই ৯ হাজার ৫শ ৯২ জন শান্তিরক্ষী বিভিন্ন মিশনে সক্রিয়, যার মধ্যে রয়েছে ২শ ৫ জন মহিলা শান্তিরক্ষী। আমাদের শান্তিরক্ষীদের সংখ্যা বর্তমানে বিশ্বে নিয়োজিত সর্বমোট সংখ্যার ৯ শতাংশ, যা সত্যিই গর্ব করার মতো। তিনি বলেন, আনন্দের বিষয় হলো আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী তাদের মহিলা শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করে চলেছে। জাতিসংঘ বর্তমানে মহিলা প্রতিনিধিত্বের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করছে। বাংলাদেশও এ বিষয়ে পিছিয়ে নেই। জাতিসংঘ সদরদফতরে উচ্চপর্যায়ের নিযুক্তিতে আমাদের মহিলা শান্তিরক্ষীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে। সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশের বিভিন্ন স্তরের সদস্যরা, আপনারা অনুকরণীয় দক্ষতা প্রদর্শন করে বিশ্বের অন্য সহযোগী শান্তিরক্ষীদের শ্রদ্ধা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছেন, এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একই সাথে শান্তি ফিরিয়ে আনার কাজে ওইসব দেশের জনগণের অকুণ্ঠ ভালোবাসা অর্জন করেছেন।

তিনি বলেন, মিশন এলাকার জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও আপনাদের উন্নত দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের মান-সর্বদা প্রশংসা বয়ে এনেছে। জাতিসংঘ এবং বিশ্বের সব শান্তিপ্রিয় দেশ আপনাদের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের দক্ষতা ও সাফল্যের প্রশংসা করেছে। আপনারা দেশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন, যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, জাতিসংঘের অধীনে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি দেশের মধ্যেও বিভিন্ন দুর্যোগের সময় ও জাতি গঠনে অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করছেন আপনারা। এ পর্যায়ে আমি অত্যন্ত সম্মানের সাথে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আপনাদের অকুতোভয় অবদানকে স্মরণ করছি। আপনাদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আমাদের মহান স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিলো। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি আপনারা দেশমাতৃকার যে কোনো প্রয়োজনে সহায়তা করতে সদা প্রস্তুত রয়েছেন। আমাদের শান্তিরক্ষীদের কর্মস্পৃহা এবং কর্মদক্ষতা অতুলনীয়। আমরা সর্বদাই জাতিসংঘের ডাকে সাড়া দিয়ে শান্তিরক্ষার কাজ করতে প্রস্তুত। আমাদের শান্তিরক্ষীরা ৪০টি দেশে ৫৪টি ইউএন মিশন সফলতার সাথে সম্পন্ন করেছে।

প্রধানমন্ত্র্রী বলেন, এ মুহূর্তে ১০টি মিশনে আমাদের শান্তিরক্ষীরা নিয়োজিত আছে। অতি সম্প্রতি জাতিসংঘ সদরদফতর এবং শান্তিরক্ষা মিশনগুলোতে উচ্চপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে আমাদের সেনা অফিসারদের নিযুক্তি প্রদানের জন্য প্রস্তাব পেয়েছি। এগুলো আমাদের সফল এবং বলিষ্ঠ কূটনীতিরই ফসল। এসব পদ আরও অধিক মাত্রায় প্রাপ্তির লক্ষে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে আমাদের সর্বমোট ১২৪ জন শান্তিরক্ষী শহীদ হয়েছেন। যার মধ্যে জুন ২০১৪ হতে মে ২০১৫ পর্যন্ত ৬ জন শান্তিরক্ষী শহীদ হয়েছেন। আমি এসব বীরসেনার এবং তাদের পরিবারকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ সালাম। এ বছর ৬ জন শহীদ শান্তিক্ষরক্ষী পরিবার এবং ১০ জন আহত শান্তিরক্ষীকে সম্মাননা প্রদান করা হলো। তিনি সব শহীদ শান্তিরক্ষীর রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। একই সাথে সব মহিলা ও পুরুষ শান্তিরক্ষী, যারা সফলভাবে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন তাদের সাফল্য ও মঙ্গল কামনা করেন।