র‌্যাব’র ব্যারাকে আত্মঘাতী হামলা : হামলাকারীর দেহ ছিন্নভিন্ন

 

আইএসের দায় স্বীকার : সব কারাগারে অধিকতর সতর্কতা বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার

স্টাফ রিপোর্টার: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে আত্মঘাতী জঙ্গি বিস্ফোরণ ঘটনার একদিন পার না হতেই শুক্রবার একই ধরনের ঘটনা ঘটলো ঢাকায়। তাও আবার রাজধানীর বিমানবন্দর সংলগ্ন প্রস্তাবিত র‌্যাব সদর দফতরের অস্থায়ী ব্যারাকে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যূহ ভেদ করে দেয়াল টপকে ঢুকে পড়ে তরুণ এক জঙ্গি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই সে সাথে থাকা সুইসাইড ভেস্টের বিস্ফোরণ ঘটায়। শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণে মুহূর্তে আত্মঘাতী জঙ্গির দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আহত হন র‌্যাবের দুজন সদস্য। দুপুরে উদ্বেগজনক এ ঘটনার পর সন্ধ্যায় ঘটনার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয় তথাকথিত ইসলামিক জঙ্গি স্টেট গোষ্ঠী আইএস। তাদের সংবাদমাধ্যম আমাক নিউজ এজেন্সির মাধ্যমে এ দাবি করা হয়। এদিকে ঘটনার পূর্বাপর বিশ্লেষণ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায় থেকে ধারণা করা হচ্ছে, এ ঘটনার সাথে জঙ্গি কোনো গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। যারা আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে এখানে বড় ধরনের নাশকতা ঘটাতে চেয়েছিলো।

বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, কথিত আইএসের সংবাদ মাধ্যম ‘আমাক’-এ জানানো হয়েছে, ঢাকায় র‌্যাব বাহিনীর একটি সামরিক ক্যাম্প লক্ষ্য করে একজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী আক্রমণ চালিয়েছে। র‌্যাবের ব্যারাকে হামলারকারীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

পুলিশ ও র‌্যাব জানিয়েছে, হামলাকারী যুবকের বয়স ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে। পরনে ছিলো কালো পাঞ্জাবি ও নীল রঙের প্যান্ট। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা, আত্মঘাতী ওই জঙ্গির শরীরে সুইসাইডাল ভেস্ট বাধা ছিলো। আত্মঘাতী হামলাকারীর মৃতদেহের কাছ থেকে একটি কালো ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে একটি অবিস্ফোরিত বোমা পাওয়া গেছে।

র‌্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, নিহত ব্যক্তির কাছে থাকা বিস্ফোরকের ধরন দেখে ধারণা করা হচ্ছে, সে কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য।

বিমানবন্দর থানার ওসি নুর-ই-আজম বলেন, নিহত হামলাকারীর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে।

ঘটনার পর পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক ও র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করার পাশাপাশি জড়িতদের চিহ্নিত করতে তাৎক্ষণিকভাবে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এটি কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর কাজ হতে পারে। তবে বিস্তারিত তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে, গতকাল শুক্রবার বেলা সোয়া ১টার দিকে ঘটনাটি ঘটেছে। হঠাৎ তারা ওই এলাকায় বিকট শব্দ শুনতে পান। প্রথমে তাদের কাছে মনে হয়েছিলো হয়তো গাড়ির টায়ার ফেটে গেছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তারা জানতে পারেন র‌্যাবের ব্যারাকের মধ্যে বড় ধরনের বিস্ফোরণে এক যুবক মারা গেছে। তখন জুমার নামাজের খুতবা চলছিলো। ‘আত্মঘাতী’ বিস্ফোরণ ঘটনায় নিহত যুবকের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। যার বয়স আনুমানিক ২৫-২৬ হবে। তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ ঘটনায় কনস্টেবল আরিফ এবং ল্যান্স কর্পোরাল মিজান নামে দুজন র‌্যাব সদস্য আহত হন।

র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের সীমানা পাঁচিলের পূর্ব দিকের দেয়াল (হাজি ক্যাম্পের পশ্চিম পাশের সীমানা দেয়াল) টপকে এক তরুণ ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর কয়েকজন র‌্যাব সদস্য যেখানে পানির চৌবাচ্চায় গোসল করছিলেন সেখানে এসে ঘুরাফেরা করতে থাকে। অপরিচিত এবং তার গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় উপস্থিত র‌্যাব সদস্যরা তাকে চ্যালেঞ্জ করলে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে বিস্ফোরণ ঘটায়। ধারণা করা হচ্ছে, তার কোমরে বোমা বাঁধা ছিলো। যাকে বলা হয় সুইসাইড ভেস্ট। যেটি আত্মঘাতী জঙ্গিরা ব্যবহার করে।

জানা যায়, দুটি বোমা ছিলো। যার একটি বিস্ফোরণ ঘটে। বোমাটি ছিলো খুবই শক্তিশালী। ওই সময় র‌্যাবের বেশির ভাগ সদস্য নিকটস্থ মসজিদে জুমার নামাজে ছিলেন। তা না হলে ব্যাপক প্রাণহানির সম্ভাবনা ছিলো। কেননা বিস্ফোরিত বোমার অসংখ্য স্পি­ন্টার ৫০ থেকে ৬০ গজ দূরে গিয়েও পড়ে। স্পি­ন্টারের আঘাতে ব্যারাকে পার্ক করা প্রাইভেট কারের সামনের গ্লাস ভেঙে যায়। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে র‌্যাব ও পুলিশসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের পদস্থ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে আসেন। ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে র‌্যাবের বোম ডিসপোজাল ইউনিট কাজ শুরু করে। ঘটনাস্থল থেকে কালো ব্যাগে থাকা একটি বোমা উদ্ধার করা হয়। পরে র‌্যাবের বোম ডিসপোজাল ইউনিট বেলা সাড়ে ৩টার দিকে সেটি নিষ্ক্রিয় করে। ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এর পাশাপাশি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) টিমও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। সন্ধ্যায় আসেন পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক ও র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। তবে ফিরে যাওয়ার সময় তারা গণমাধ্যমে কোনো কথা বলেননি।

উল্লেখ্য, দেশে এই প্রথম আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দফতরে কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলার ঘটনা ঘটলো। এর আগে ২০০৯ সালে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি লিফলেট ও চিঠি পাঠিয়ে র‌্যাব সদর দফতর উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলো। দেশে জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের পর থেকে ছোট-বড় একাধিক জঙ্গি হামলায় টার্গেট ছিলো ব্যক্তি বা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভবন। সে বিবেচনায় গতকাল র‌্যাবের ব্যারাক জঙ্গিদের প্রথম টার্গেট হলো।

এদিকে হামলার পর দেশের সকল বিমানবন্দর, কারাগার, নৌবন্দরসহ সারাদেশে সর্তক অবস্থা (অ্যালার্ট) জারি করা হয়েছে। এর আগে গত বুধবার চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে পুলিশের অভিযানকালে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ও গুলিতে এক নারী ও এক শিশুসহ চার জন নিহত হয়। নিহত নারী জঙ্গির পাশে পাওয়া যায় বোমায় ক্ষত-বিক্ষত এক শিশুর লাশ।

ঘটনা সম্পর্কে র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিকদের বলেন, নির্মাণাধীন ব্যারাকে প্রবেশের জন্য একটা মেন গেট আছে। এখানে যানবাহনসহ মানুষের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আমাদের ডান পাশের যে বাউন্ডারি রয়েছে, সেখানে হাজি ক্যাম্প ও স্থাপনার মাঝখান দিয়ে রাস্তা গেছে। গ্রিল ও দেয়ালের সমন্বয়ে গঠিত এই সীমানা পাঁচিলর। ব্যারাকে থাকা সদস্যদের জন্য সীমানা সংলগ্ন জায়গায় কাপড় ধোয়া ও গোসলের ব্যবস্থা আছে। বেলা ১টা ৫ মিনিটে সীমানা পাঁচিলের ওপর দিয়ে এক যুবক প্রবেশ করে। অপরিচিত ব্যক্তি হওয়ায় তাকে চ্যালেঞ্জ করা হয় যে সে কোথায় যাচ্ছে। চ্যালেঞ্জ করার পরিপ্রেক্ষিতেই ওই যুবক যে পথ দিয়ে এসেছিলো সেখান দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং সাথে সাথে একটা বিস্ফোরণ হয়। তার সাথে যে বোমা ছিলো সেই বোমার বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, ওখানে যে দুজন র‌্যাব সদস্য ওই ব্যক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, তারা বোমার বিস্ফোরণে কিছুটা আহত হয়েছেন। তত্ক্ষণাত তাদের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। তাদের অবস্থা আশঙ্কামুক্ত এবং তারা এখন মোটামুটি সুস্থ আছেন।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মুফতি মাহমুদ বলেন, হামলাকারী কোন দলের বা কোন গোষ্ঠীর, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে তার কাছে থাকা বিস্ফোরকের ধরন দেখে ধারণা করা হচ্ছে, সে কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য। ঘটনার সময় র‌্যাব ক্যাম্পের পাশের একটি মসজিদে ছিলেন আসাদুজ্জামান নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘আমি তখন মসজিদে ছিলাম। তখন আনুমানিক ভেলা ১টা বাজে। হঠাতই বিকট শব্দ শুনতে পাই। পরবর্তীতে এসে দেখি ওই এলাকায় র‌্যাবের লোকজন।’ তিনি আর কিছু জানাতে পারেননি।

প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের শুরু থেকে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সময়ে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী লেখক, ব্লগার, প্রকাশকরা। গত বছর জুলাই মাসে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও শোলাকিয়ায় ঈদের দিন জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর গত ৭ মার্চ কুমিল্লায় একটি বাসে তল্লাশির সময় দুই জঙ্গি পুলিশের দিকে বোমা ছুড়ে মারে। তাদের মধ্যে একজনকে সাথে নিয়ে ওই রাতেই মিরসরাইয়ের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও বোমা উদ্ধার করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। এরপর গত ১৫ মার্চ বুধবার বিকালে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে এক বাড়ি থেকে বিস্ফোরকসহ এক জঙ্গি দম্পতিকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাশের ওয়ার্ডে আরেক বাড়িতে দীর্ঘ ১৯ ঘণ্টা অভিযান চালায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ও সোয়াট। আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ও গুলিতে এক নারীসহ ৪ জঙ্গি নিহত হওয়ার মধ্যদিয়ে সীতাকুন্ড অভিযানের সমাপ্তি ঘটে। নিহত নারী জঙ্গির পাশে পরে এক শিশুর লাশ পাওয়া যায়।

এর আগে ২০১৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর আশকোনায় হাজি ক্যাম্পের কাছে একটি বাড়িতে কোমরে ‘সুইসাইডাল ভেস্ট’ পরে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন এক নারী জঙ্গি। এর আগে চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ঘাঁটি বানৌজা ঈঁসা খানের ভেতরে বানৌজা পতেঙ্গা মসজিদে বিস্ফোরণের পর আটক আবদুল মান্নানের কাছ থেকে বোমাসহ কয়েকটি সুইসাইডাল ভেস্ট উদ্ধার করা হয়।

সারাদেশে অ্যালার্ট: র‌্যাবের ব্যারাকে হামলার ঘটনার পর কারাগার, বিমানবন্দর, নৌবন্দরসহ সারাদেশে সতর্কতা (অ্যালার্ট) জারি করা হয়েছে। পাশাপাশি দেশের থানাগুলোতেও নিরাপত্তা জোরদার করার পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদের  বুলটপ্রুফ  জ্যাকেট ও হেলমেট পরে থানার গেটে ডিউটি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

পুলিশ মহাপরিদর্শক ( আইজি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, নিরাপত্তার ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা রয়েছে।

কারা-অধিদফতরের মহাপরির্দশক ( আইজি প্রিজন)  ব্রিগেডিয়ার  জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন বলেন, কারাগারগুলোতে এমনিতেই সব সময় অ্যালার্ট জারি থাকে। তবে জঙ্গি হামলার পর সারাদেশের কারাগারগুলোতে অধিকতর সতর্ক থাকার নির্দেশে দেয়া হয়েছে।

এদিকে বিমানমন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান তুহিন গণমাধ্যমকে জানান, সব বিমানবন্দরে অধিকতর সতর্কতা জারির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শাহজালাল বিমানবন্দরের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা রাশেদা সুলতানা জানান, শাহজালালসহ সব বিমানবন্দরে বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।