রায় কার্যকরে কালক্ষেপণ নিয়ে নানা প্রশ্ন

স্টাফ রিপোর্টার: মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ নিয়ে নানা প্রশ্ন ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। একই সাথে সৃষ্টি হয়েছে কৌতূহলের। রিভিউ আবেদন খারিজের পর দুদিন পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও ফাঁসি কার্যকর হয়নি। এ নিয়েই চলছে জোর আলোচনা। বিশেষ করে ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা নিয়ে শাসক দল আওয়ামী লীগ সমর্থিত শীর্ষ আইনজীবী ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এ প্রশ্ন এবং বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে।

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড কবে কার্যকর হবে, নাকি আদৌ হবে না- এ নিয়েও ঘরে-বাইরে, পাড়ায়- মহল্লায়, চায়ের স্টলে, রাজনীতির টেবিলে আলোচনার শেষ নেই। ফাঁসির রায় এখনও কার্যকর না হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবে না বলে ঘোষণা দিয়ে শাহবাগে অবস্থান নিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ।

রায় কার্যকরে বিলম্বের কারণ বোধগম্য নয়- দাবি করে আওয়ামী লীগের সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ শুক্রবার বলেন, আমি তো ফাঁসির দণ্ড কার্যকরে কোনো বাধা দেখছি না। তারপরেও কেন বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, রায় কার্যকর করা এক থেকে দেড় ঘণ্টার বিষয়। তা সত্ত্বেও বিষয়টি নিয়ে এখন যা চলছে তা সত্যিই অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনভিপ্রেত।

আওয়ামী লীগ সরকারেরই অপর সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু বলেন অন্য কথা। শুক্রবার তিনি বলেন, কারাবিধি অনুযায়ী ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত একজন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানানোর জন্য ন্যূনতম ৭ দিন সময় পান। মুহাম্মদ কামারুজ্জামনকে সেই সময় দেয়া হয়েছে বলেই রায় কার্যকরে বিলম্ব ঘটছে। এখানে অন্য কোনো বিষয় নেই। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক কিংবা বিভ্রান্তি ছড়ানোরও সুযোগ নেই।

অবশ্য এ মতের বিরোধিতা করে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে সম্পৃক্ত থাকার কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিচার হয়েছে। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল তাকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে গেছেন। সেখানেও তার ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখা হয়। এরপর মুহাম্মদ কামারুজ্জামান রিভিউ আবেদন করেন, তাও খারিজ হয়। এরপর তার জন্য আর একটি পথই খোলা থাকে, আর তা হলো নিজের অপরাধ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে অনুকম্পা প্রার্থনা করে প্রাণভিক্ষা চাওয়া।

সাবেক এ আইনমন্ত্রী আরও বলেন, বিশেষ আদালতে বিচার হওয়ায় এখানে কারাবিধি প্রযোজ্য নয়। যারা এটি বলছেন, তারা না বুঝেই বলছেন। অন্য মামলা আর এ মামলার পার্থক্যটা আগে বুঝতে হবে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট কেন কারাগারে গিয়ে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সাথে দেখা করবেন? তাদের কি কাজ সেখানে? আমার কাছে বিষয়টি বোধগম্য নয়।

ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ আরও বলেন, অপরাধী একটি শাদা কাগজে নিজের দোষ স্বীকার করে অল্প কথায় রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন। এ আবেদনটি কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। আইন মন্ত্রণালয় তাদের মতামত দিয়ে আবেদনটি আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠাবে। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবেদনটি পাঠাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। পরে প্রধানমন্ত্রীর মতামতসহ আবেদনটি পাঠানো হবে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার সিদ্ধান্ত জানাবেন।

ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, পুরো বিষয়টি সম্পন্ন করতে মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় প্রয়োজন। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির রায় কার্যকর করার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ওই মামলায়ও অভিযুক্ত আসামিদের রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার পরপরই রায় কার্যকর করা হয়। রায় কার্যকরের আগে পাঁচজনের মধ্যে কর্নেল (অব.) ফারুক ছাড়া বাকি কেউই রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করেননি। তিনি জানান, কর্নেল (অব.) ফারুকের আবেদনের বিষয়টিও তখন এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যেই নিষ্পত্তি হয়।

এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির আসামির প্রাণভিক্ষার আবেদনের জন্য যৌক্তিক সময়ের যে কথা বলা হচ্ছে- তা সাত দিন হতে পারে না। প্রাণভিক্ষার আবেদন লিখতে যতোটা সময় প্রয়োজন ততোখানি সময় দেয়াই যৌক্তিক বলে মনে করি। মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বেলায় রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদনের জন্য কারাবিধি প্রযোজ্য নয় বলে দাবি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ড. তুরিন আফরোজও। শুক্রবার তিনি বলেন, কারাবিধির কথা যদি বলা হয় তাহলে তো আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি অবৈধ হয়ে যায়। ড. তুরিন আফরোজ বলেন, আইনে নির্বাহী নির্দেশে রায় কার্যকর করার কথা বলা আছে। তিনি মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করতে অহেতুক বিলম্ব করা হচ্ছে- দাবি করে বলেন, এতে বিচারপ্রার্থীরা আশাহত হচ্ছেন।

ফাঁসি কার্যকর না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন একাত্তরের ঘাতক দাদাল নিমূর্ল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবীর। শুক্রবার তিনি বলেন, সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তারা যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি অনুকম্পা দেখাচ্ছে- যা বিচারপ্রার্থীদের জন্য অত্যন্ত বেদনার ও কষ্টদায়ক। তিনি অবিলম্বে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করার দাবি জানিয়ে বলেন, যতো দ্রুত এই রায় কার্যকর হবে, ততো জাতি শাপমুক্ত হবে।

অভিযোগ রয়েছে, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করার বিষয়টি প্রশাসনিক জটিলতায় ঝুলে আছে। শুক্রবার এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তার রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়নি। সকালে তানজিম মোহাম্মদ নাজিম এবং মাহবুব জামিল নামে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট কারাগারে গিয়ে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সাথে দেখা করলেও কি আলোচনা হয়েছে সে বিষয়ে মুখ খোলেননি তারা। দু ম্যাজিস্ট্রেট সকাল ১০টার দিকে কারাগারে যান। বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে বের হন। কেন কারাগারে গিয়েছিলেন, এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তারা মুখ খোলেননি। সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলীও এ বিষয়ে কিছু বলেননি।

এর আগে বৃহস্পতিবার মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা তার সঙ্গে দেখা করার পর সাংবাদিকদের জানান, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনের বিষয়ে তিনি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবেন। কারা কর্তৃপক্ষ ওই দিন দাবি করেন, প্রাণভিক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত না জানানোয় আটকে আছে তার ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা সে বিষয়ে জানার জন্য কিছুক্ষণের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট কারাগারে যাবেন বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। ওই দিন ম্যাজিস্ট্রেট না গেলেও শুক্রবার তারা কারাগারে গিয়ে কথা বলেন মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সাথে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইন-১৯৭৩-এর ২০(৩) অনুযায়ী এ আইনের অধীনে দণ্ডিতদের সাজা কার্যকর করবে সরকার। রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার মধ্যদিয়ে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় এখন কামারুজ্জামানের সাজা কার্যকরের বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। প্রাণভিক্ষার জন্য কতোটুকু সময় তাকে দেয়া হবে তাও নির্ভর করছে সরকারের ওপর।