রাস্তায় সবজি শুকোতে দেয়া আলমসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা

বেনাপোলে বাড়িতে বাড়িতে কান্নার রোল : সাত শিশুকে নিজ গ্রামে দাফন

দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আজ শোক পালনের ঘোষণা : শার্শায় একদিনের ছুটি

 

স্টাফ রিপোর্টার: মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় নিহত ৭ শিশুশিক্ষার্থীর স্মরণে আজ সোমবার সারাদেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শোক পালনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার পরে শোকপ্রকাশ করা হবে। একই সাথে দোয়া মাহফিল ও তাদের আত্মার শান্তির জন্য মাগফেরাত কামনা করা হবে। গতকাল রোববার প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এ ঘোষণা দেন। অপরদিকে রাস্তায় সবজি শুকোতে দেয়া চৌগাছা মান্দারতলার আলম ও শহিদুল, বাসচালক ও চালকের সহকারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে একাধিক তদন্ত কমিটিও।

যশোরের বেনাপোলে সাত ক্ষুদে শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় এলাকা জুড়ে চলছে শোকের মাতম। প্রিয় সন্তানদের হারিয়ে যেন শোকে পাথর হয়ে গেছেন মা-বাবা। কারো বা বুকফাটা কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে এলাকার আকাশ-বাতাস। সন্তানহারা বাড়িগুলোতে থেমে থেমে উঠছে কান্নার রোল, আহাজারি, আবার নেমে আসছে কবরের নিস্তব্ধতা। শুধু ছোট আঁচড়া, নমাজ বা গাজীপুর গ্রাম নয়, শোকের আবহ ছাড়িয়ে পড়েছে বেনাপোল ছাড়িয়ে গোটা জেলায়।

গত শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে যশোরের চৌগাছার-মহেশপুর সড়কের কাঁদবিলা গ্রামের ঝাউতলায় শিক্ষা সফরের বাস (রাজশাহী-মেট্রো-জ-১১-০০৮০) রাস্তার পাশে পুকুরে পড়ে গেলে ঘটনাস্থলেই ওই ৭ শিশু শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। আহত হয় আরও প্রায় অর্ধশত। গতকাল রোববার দুপুরে জানাজা শেষে নিজ নিজ গ্রামে ৭ শিশুকে দাফন করা হয়। নিহতদের স্মরণে শার্শা উপজেলায় একদিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বেনাপোল পৌরসভার পক্ষ থেকে ৩ দিনের শোক ঘোষণা করা হয়। একই সাথে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে।

নিহতরা হলো- বেনাপোলের ছোট আঁচড়া গ্রামের সৈয়দ আলীর দু মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া (১০) ও তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী জেবা আক্তার (৮), একই গ্রামের গ্রামের ইউনুস আলীর মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী মিথিলা (১০), রফিকুল ইসলামের মেয়ে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী রুনা আক্তার মীম (৯), লোকমান হোসেনের ছেলে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শান্ত (৯), গাজীপুর গ্রামের সেকেন্দার আলীর ছেলে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সাব্বির হোসেন (১০) ও নমাজ গ্রামের হাসান আলীর মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী আঁখি (১১)। দুর্ঘটনায় নিহত জমজ বোন বেনাপোলের ছোট আঁচড়া গ্রামের সুরাইয়া ও জেবার মা কিছুদিন আগে মারা যান। স্ত্রী হারানোর পর সৈয়দ আলী মেয়ে দুটিকে বুকে করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছিলেন। তিনি প্রায় বোবা হয়ে গেছেন। তাদের প্রতিবেশীরা বলছে, এ কেমন মৃত্যু! খোদার এ কেমন পরীক্ষা! নিহত দু সহোদরার নানী নুরুন্নাহার বেগম বলেন, পিকনিকে যাওয়ার সময় আমাকে সালাম দিয়ে বলে গেছে, নানু চলে যাচ্ছি, দোয়া করবেন। কিন্তু এই চলে যাওয়াই যে শেষ চলে যাওয়া হবে তা মানতে পারছি না।

পঞ্চম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী মিথিলার (১০) পিতা ছোট আঁচড়া গ্রামের বাসিন্দা ইউনুস আলী জানান, তাদের তিন ভাইয়ের দু মেয়ে। সবার চোখের মণি ছিলো মিথিলা। তাকে সবাই চোখে চোখে রাখতো। সেই চোখের মণি সবাইকে অন্ধ করে দিয়ে চলে গেল না ফেরার দেশে। শুধু সুরাইয়া, জেবা কিংবা মিথিলার পরিবার নয়; সাত সাতটি সোনার টুকরোকে হারিয়ে শোকে পাথর এখন গোটা এলাকা।

দুপুরে বেনাপোল বলফিল্ডে নিহত ৭ শিশুর দুটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় দশ সহস্রাধিক মানুষ অংশ নেন। জানাজা শেষে নিজ নিজ গ্রামে তাদের দাফন করা হয়। নিহতের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা জানাতে ছুটে গেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শ্যামল কান্তি ঘোষসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা। মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আজ (সোমবার) দেশের সকল প্রাথমিক স্কুলে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।

তদন্ত কমিটি ও ক্ষতিপূরণ: দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাবিনা ইয়াসমীনকে প্রধান করে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে এক সপ্তার মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।

যশোরের জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবারের ক্ষতিপূরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে। সরকারিভাবে আহতদের চিকিত্সা সহায়তা দেয়া হবে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সুব্রত কুমার বণিক জানান, যশোরের প্রায় ৬ হাজার শিক্ষক প্রত্যেকে নিহতদের পরিবারের জন্য একশ টাকা করে প্রদান করবেন।

জনকে আসামি করে মামলা: দুর্ঘটনার পর পুলিশ বাদী হয়ে চৌগাছা থানায় একটি মামলা করেছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে সড়কে সবজি শুকোতে দেয়া চৌগাছা উপজেলার মান্দারতলা গ্রামের আলম ও শহিদুল, বাসচালক ঝিকরগাছার ইসরাফিল ও তার সহকারীকে। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কেউ আটক হয়নি। গতকাল রোববার বেলা ১১টার দিকে কপিকল রেকার দিয়ে দুর্ঘটনাকবলিত বাসটি উদ্ধার করে চৌগাছা থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া চৌগাছা প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু জাফর জানান, অন্ধকার এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা না থাকায় উদ্ধার কাজে বিলম্ব হয়েছে। যে কারণে মৃতের সংখ্যা বেড়েছে। বেনাপোল পোর্ট থানার ওসি মোশাররফ হোসেন জানান, দুর্ঘটনার পরপরই পালিয়ে যায় বাসচালক। তাকে আটকের জোর চেষ্টা চলছে।