রাস্তাঘাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ২৯টি প্রকল্পে ৭৬ লাখ টাকা লুটপাটের অভিযোগ

অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলায় চলছে অনিয়ম

 

স্টাফ রিপোর্টার: অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে চুয়াডাঙ্গার উপজেলায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের অর্থ ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা, ইউপি সদস্য ও কথিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে। কর্মসূচি ব্যর্থ হতে চলেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও বিষয়টি স্বীকার করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে কর্তৃক বাস্তবায়িত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি কর্মসূচির আওতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে জীবননগর উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে ২৯টি প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেয়া হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে ৭৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ। নিয়োগপ্রাপ্ত অনেক শ্রমিকদের মধ্যে রয়েছে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীসহ ব্যক্তিবর্গের নাম। প্রকল্পের কাজের জন্য নিয়োগকৃত শ্রমিকদের মধ্যে সিংহভাগই অনুপস্থিত থাকছেন। অথচ তাদের নামেই কাজের হাজিরা উঠিয়ে বরাদ্দকৃত অর্থ লুটপাট করছেন সংশ্লিষ্ট কতিপয় ব্যক্তি। সরেজমিনে পরিদর্শনে ৪০ দিনের কর্মসূচি হিসেবে পরিচিত এ প্রকল্পের শ্রমিক নির্বাচন থেকে শুরু করে পরতে পরতে অনিয়মের চিত্র পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সেলিম রেজা শুরু থেকেই প্রকল্পের কাজ তদারক করছেন। তিনি বলেন, একটি প্রকল্পের কাজ দেখতে গিয়ে আমি একজনও শ্রমিক পাইনি। অন্যান্য প্রকল্পেও তালিকার তুলনায় শ্রমিক কম পেয়েছি। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ও তদারকি বাড়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির (দ্বিতীয় পর্যায়) আওতায় উপজেলায় মোট ৭৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ওই বরাদ্দে ৬টি ইউনিয়নে রাস্তাঘাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চত্বর মাটি দিয়ে সংস্কারের জন্য ২৯টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ৯৫৫ জন শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ১৬ মে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘুরে কয়েকটি প্রকল্পে কোনো শ্রমিকই পাওয়া যায়নি। আর তালিকা অনুযায়ী শ্রমিক পাওয়া যায়নি কোনোটিতেই। এছাড়া নীতিমালা অনুযায়ী, প্রকল্পের তথ্যসংবলিত সাইনবোর্ড দর্শনীয় স্থানে টানানোর কথা। কিন্তু একটি প্রকল্পেও তা টানানো হয়নি। উথলী ইউনিয়নের সেনেরহুদা রেলগেট থেকে দিঘরীর মাঠ পর্যন্ত রাস্তার কাজে ৩২ শ্রমিকের নাম থাকলেও ২৬ জনকে পাওয়া যায়। এখানে আটজন পুরুষ শ্রমিকের পরিবর্তে নারীদের কাজ করতে দেখা যায়। নারী শ্রমিকেরা বলেন, তারা ১০০ থেকে ১২০ টাকা হারে মজুরি পান। শ্রমিক সর্দার সাইফুল ইসলাম বলেন, বদলি শ্রমিক দিয়ে কাজের বিষয়টি কর্মকর্তারা জানেন।

আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়নের ডুমুরিয়া মাঝেরপাড়া থেকে রেলস্টেশন অভিমুখে রাস্তায় গিয়ে প্রকল্পের ৩০ জন শ্রমিকের একজনকেও পাওয়া যায়নি। একই প্রকল্পে আন্দুলবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে মাটি ভরাটের কথা উল্লেখ রয়েছে। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল আলীম বলেন, বিষয়টি তিনি এই প্রতিবেদকের কাছে প্রথম শুনলেন। প্রকল্প সভাপতি স্থানীয় ইউপি সদস্য মোছাদ্দেক আলী বলেন, প্রকল্পের শ্রমিকেরা ১০ কিলোমিটার দূরে নিধিকুণ্ড এলাকায় কাজ করছেন। কিন্তু নিধিকুণ্ড এলাকায় গিয়েও কোনো শ্রমিককে পাওয়া যায়নি।

উথলী ইউনিয়নের মনোহরপুর গ্রামের দক্ষিণপাড়ার সামসুল ফকিরের বাড়ি থেকে মনিরুদ্দিনের বাঁশবাগান পর্যন্ত ৪৩ জন শ্রমিকের কাজ করার কথা থাকলেও একজনকেও পাওয়া যায়নি। সামসুল ফকির বলেন, ২ মে কাজ শুরু হলে তিন-চার দিন শ্রমিকেরা রাস্তায় নামমাত্র কিছু মাটি ছিটিয়ে দেন। তারপর থেকে কারও খোঁজ নেই। এ প্রকল্পের তালিকাভুক্ত কয়েকজন শ্রমিক এই প্রতিবেদককে বলেন, প্রকল্পের প্রথম থেকেই ২৩-২৪ শ্রমিক কাজ করছেন। তবে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাকা গ্রামে নির্মাণাধীন একটি সেতুর পাশে মাটি ভরাটের কাজ করানো হচ্ছে। অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রকল্প সভাপতি ইউপি সদস্য নজরুল ইসলামের ফোনে ফোন দেয়া হলেও তিনি তা ধরেননি। প্রকল্পে অনিয়মের কথা উপজেলা পিআইও কার্যালয়ের কর্মকর্তারাও স্বীকার করছেন। তবে তাদের ভাষ্য, লোকবল কম থাকায় ঠিকমতো কাজের তদারক করা যাচ্ছে না।

পিআইও কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী এমদাদুল হক বলেন, তিনি ২৯টি প্রকল্পের বেশির ভাগই সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। তিনি যেসব এলাকায় গেছেন, সেখানে তালিকা অনুযায়ী শ্রমিক পাননি। পিআইও আশরাফুল ইসলাম স্বীকার করেন, নীতিমালায় থাকলেও কোনো প্রকল্পে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়নি, এটা ঠিক। আর সরেজমিন পরিদর্শনে তিনিও প্রতিটি প্রকল্পে শ্রমিক কম পেয়েছেন। তিনি বলেন, লোকবল কম থাকার কারণে যথাযথভাবে কাজের তদারক করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।