রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি পাকিস্তানের জাতীয় পতাকায় অগ্নি সংযোগের দায়ে কারাভোগকারী বীর মঈন উদ্দীন

রহমান মুকুলঃ মহান মুক্তিযুদ্ধোত্তর ৪৪ বছরেও অগ্নিসেনা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি পাকিস্তানের জাতীয় পতাকায় প্রথম অগ্নি সংযোগের দায়ে কারাভোগকারী আলমডাঙ্গা কালিদাসপুর গ্রামের অসম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা মঈন উদ্দীন। জীবন সায়াহ্নে পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে এ অসামান্য অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাবি করেছেন তিনি।
১৯৭০ সালের মে মাস। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের রাষ্ট্র প্রধান। দেশে মার্শাল ল জারি করা হয়েছে। ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনরত ঢাকার পোস্তগোলা ও চট্রগ্রামের শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে শ্রমিক হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় বিস্ফোরণোন্মুখ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সারাদেশের মতো আলমডাঙ্গায়ও তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামালের নেতৃত্বে আলমডাঙ্গা পাইলট হাইস্কুলের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মার্শাল ল উপেক্ষা করে শহরের হাইরোডে মিছিল এগিয়ে চলে। মিছিল অল্পক্ষণেই পৌঁছে যায় আলমডাঙ্গা থানার সামনে। মিছিলের পুরোভাগে থেকে রাস্তার দু’পাশের সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা তোলার দায়িত্ব পালন করছিলেন কালিদাসপুরের মৃত গঞ্জের আলীর ছেলে মঈন উদ্দীন। মিছিল বর্তমান স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে পৌঁছুলে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ ও ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া নজরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে মঈন উদ্দীন ঢুকে পড়েন থানা চত্বরে। দাবি তোলেন পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার পাশাপাশি কালো পতাকা উড্ডীনের। কিন্তু আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রস্তাব মানতে রাজি হয় না পুলিশ কর্মকর্তা এসআই সিরাজুল ইসলাম। পুলিশের সাথে বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে কিশোর মঈন উদ্দীন ঘটিয়ে ফেললেন এক অভাবনীয় ঘটনা। তিনি থানা চত্বরে উড্ডীন পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা দ্রুত নামিয়ে রাগে ক্ষোভে তাতে অগ্নি সংযোগ করে ভস্মীভূত করে বসলেন এবং পতাকার দণ্ডে উড়িয়ে দেন আন্দোলনকারীদের কালো পতাকা। দূরে কাঁঠাল গাছের নিচে অপেক্ষারত অন্যান্য সংগ্রামী সাথী চিকন-চাকন লম্বাটে এক কিশোরের এতোবড় স্পর্ধা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়। আতঙ্কে চোখ সরু করে দেখছিলেন তারা। স্তম্ভিত হয়ে পড়ে পুলিশ-প্রশাসনও। এ গল্প বলার সময় বয়োবৃদ্ধ মঈন উদ্দীনের চোখ দুটি চকচক করছিলো। যেন এখনও তিনি চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করে বয়ান দিচ্ছেন সেই কাহিনীর। এ দুঃসাহসিক ঘটনাকে তৎকালীন সরকার রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে নেয়। তখন তিনি মাত্র ১০ম শ্রেণির ছাত্র। আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। মামলা করা হয় মার্শাল ল আইনে। গ্রেফতার হন তিনি। সমস্ত দোষ নিজ কাঁধে তুলে নেন তিনি। সামরিক বিধিতে বিচারে ১৯৭০ সালে ২১ জুনে ৬ মাসের কারাদণ্ডাদেশ হয় তার। কিশোর অপরাধী হিসেবে শাস্তি কিছুটা লঘু করা হয়। ওই বছর ১৭ ডিসেম্বর তিনি কারামুক্ত হন। জেল থেকে বের হয়ে দেখেন দেশে যুদ্ধের পূর্বাবস্থা বিরাজ করছে। ৭১ সালের এপ্রিল মাসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে তিনি ভারতের বেতাই ও আসামের লোয়ার হাফলং-এ ট্রেনিং এ যোগদান করেন। ট্রেনিং শেষে সর্বাত্মক যুদ্ধ করেছেন থানা মুজিব বাহিনির কমান্ডার কাজী কালাল ও মারফত আলীর নেতৃত্বে। মিরপুর উপজেলার খলিষাকুণ্ডি, কাকিলাদহ, হালসা ও আলমডাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেছেন উল্লেখযোগ্য বীরত্বের সাথে। খলিষাকুণ্ডির সম্মুখ যুদ্ধে এ কিশোর ফায়ারিং গ্রুপের লিডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদান কিংবদন্তীর মতো। অথচ তার এ অসামান্য অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি তিনি পাননি।
এলাকাবাসী দেশের মুক্তি সংগ্রামে তার অসামান্য অবদানকে স্বীকৃতি দিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ এলাকাবাসী তাকে অগ্নিসেনা উপাধি দিয়েছেন। আলমডাঙ্গা পৌরসভা ২০১২ সালে তাকে অগ্নিসেনা হিসেবে স্বর্ণ পদকে ভূষিত করেছে। ১৯৯৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের সান্ধ্যকালীন অধিবেশনে এলাকাবাসীর ইচ্ছার সাথে সঙ্গতি বিধান করে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতির জন্য স্পীকারের নিকট অনুরোধ করেছিলেন চুয়াডাঙ্গা -১ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য শামসুজ্জামান দুদু। আলমডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র মীর মহিউদ্দীনও তার রাষ্টীয় স্বীকৃতির জন্য প্রধানমন্ত্রীর দফতরে বেশ কিছু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। তবে সে চেষ্টার কোনো শুভ ফলোদয় হয়নি।