রাতের দর্শনা : কাস্টমসের ঘণ্টা ও কেরুজ সাইরেন ভেঙে দেয় রাতের নিস্তব্ধতা

 

দর্শনা অফিস: চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে, সীমান্ত ঘেঁষা ছোট শিল্প শহর দর্শনা। শহরটি ছোট হলেও এ শহর ইতিহাস ঐতিহ্যে মণ্ডিত। জনবহুল এ শহরে রাতদিন মানুষের কোলাহল লেগেই থাকে। রাত যতো গভীর হয়, মানুষের চলাচল কমে আসে। তুলনামূলক শান্ত শহর দর্শনায় গভীর রাতে সমাজের সাধারণ মানুষের দেখা খুব একটা না মিললেও ছিঁচকে চোর, চোরাকারবারি ও মাদক বিক্রেতাদের আনাগোনা দেখা যায়। গুরুত্বপূর্ণ এ শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র থাকলেও টহলের জন্য নিজস্ব কোনো যানবাহন নেই। তাই বলে থেমে থাকে না পুলিশ। নিঝুম রাতে পুলিশের ভাড়া নেয়া ইঞ্জিনচালিত আলমসাধু, নছিমন ও করিমনের বিকট শব্দই জানান দেয় পুলিশের আগমন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য বেশ কয়েকটি দূরপাল্লার পরিবহন দর্শনা থেকে গভীর রাতে ছেড়ে যায়। যে কারণে পরিবহনের কাউন্টারগুলোর একটি দরজা যেন উঁকি দিয়ে থাকে। দর্শনায় দুটি রেল স্টেশন রয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক স্টেশন। যেখানে রয়েছে রেল ইয়ার্ড। ইয়ার্ডে রাতভর ট্রাক চালক, হেলপার, শ্রমিকদের কোলাহল শোনা যায়। মাঝে মাঝে নিরাপত্তা কর্মীদের লম্বা বাঁশির শব্দ মনে করিয়ে দেয় সজাগের কথা। এক সময় রেল ইয়ার্ড চোর ও লুটেরাদের অস্ত্রের ঝনঝনানি এখন আর না থাকলেও ছিঁচকে চোর ও ভ্রাম্যমাণ পতিতাদের ঘোরাফেরা চোখে পড়ে। রেলবাজারের ঐতিহ্যবাহী ফুলতলা চত্বর প্রায় ৩০ বছর ধরে জাকিরের চায়ের দোকানের কারণেই রাতভর চা পানকারীদের আনাগোনা লেগেই থাকে। ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা চা দোকানি জাকির গভীর রাতে খানিক ঝিমিয়ে পড়লেও চা পানকারীদের হাকারে ফের চোখ মেলে চা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দর্শনা বাসস্ট্যান্ড পুরো নিস্তব্ধ থাকলেও ব্যবসায়ীদের পালাক্রমে পাহারায় তটস্থ হয়ে থাকে চোরেরা। হল্টস্টেশন এলাকায় ট্রেন যাত্রীরা নিরাপত্তার কারণে মঙ্গলের দোকানে টেলিভিশন দেখে সময় পার করে। কয়েক যুগ ধরে মঙ্গলের দোকান ২৪ ঘণ্টা খুলে রাখা হচ্ছে। বর্তমানে দোকানটি পরিচালনা করেন দু ভাই হানা ও আনা। রাতের ট্রেনের সময় স্টেশন এলাকায় বেশ কোলাহল দেখা গেলেও ফের নেমে আসে নীরবতা। দর্শনা পুরাতন বাজারের দু ভাই বাদল ও নুরুলের দোকান রাতভর খোলা থাকে স্বাধীনতার পর থেকেই। যে কারণে অনেক পথচারীকেই ওই দোকানে বসে থাকতে দেখা যায়। চুপচাপ রাতে দর্শনা রেলবাজার, পুরাতন বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে ষাটোর্ধ্ব বয়সী তৈয়ব আলী, শমসের, কেইটো, বয়াদি, আবু তালেবসহ বেশ কয়েকজন পাহারাদারের হাকার ও পদচারণায় অনেকটাই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রাত পার করেন ব্যবসায়ীরা। দর্শনার তিনটি স্থানে পথ চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ। মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড, ঘুঘুডাঙ্গা ও জোড়াবটতলা নামক স্থানে রাত বাড়ার সাথে সাথে পথচারীদের গা ছমছম করে ছিনতাই আতঙ্কে। বছরে ৩ মাস কেরুজ আখ মাড়াই মরসুম চলাকালীন মিল আঙিনায় শ্রমিক-কর্মচারী ও আখচাষিদের উপস্থিতি মুখোর থাকে। সেই সাথে কৃষকদের বিনোদনের জন্য গভীর রাতে কেরুজ নিজস্ব মাইক থেকে ভেসে আসে হারানো দিনের যতো গান। এদিকে ঘণ্টায় ঘণ্টায়  কেরুজ চিনিকলের হুইসেল ও দর্শনা কাস্টমস সার্কেলের ঘণ্টার শব্দ ভেঙে দেয় রাতের নিস্তব্ধতাকে।