রাতের চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন : রকমারি চিত্র

 

উজ্জ্বল মাসুদ/রহমান রনজু: না, বিচিন্তার বাগ দেয়া কড়কড়ে মোরগের মতো মোটরবাইক নিয়ে নয়, মাথাভাঙ্গার দুইজন সংবাদকর্মী চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনে গিয়েছিলাম পায়ে হেঁটে। উদ্দেশ্য? ট্রেনভ্রমণ কিম্বা কোনো ভ্রাম্যমাণের খোদ্দের হওয়া নয়, মধ্যরাতের স্টেশন দেখা। গতরাত ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত হাঁটি হাঁটি পা পা করে প্লাটফরম ও তার আশপাশে ঘুরে পাওয়া গেছে রকমারি চিত্র। জানা গেছে কিছু পুরোনো তথ্যও।

চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনে সন্ধ্যা নামা মানেই এক সময় জমাজমাট হয়ে উঠতো বটতলা পানির ট্যাঙ্কের নিকট রুমার মদের চালা। অপর প্রান্তে জমে উঠতো টুকুর তিন তাস। ফিতে নিয়েও সরলসোজা রেলগাড়ির যাত্রীদের ফতুর করতে ঘুর ঘুর করতো বাদল-বাবুর সঙ্গবদ্ধ চক্র। এখন? রুমার সেই মদের চালা নেই। স্টেশন প্লাটফরমে পা পড়ে না জুয়াড়ি টুকুরও। বাদল দা তো কবেই পরলোকে। টুকুর জুয়ার আসর কখনো বসে বুজরুকগড়গড়ির মাঠে, কখনো হাটকালুগঞ্জের বিপরীতে দৌলাতদিয়াড় পীরপুরের বাগানে। নদীতে নাও বাঁধা থাকে জুয়াড়িদের পারাপারে। রাতের চুয়াডাঙ্গা স্টেশন দেখতে যাওয়ার আগে দীর্ঘদিন ধরে স্টেশনে ব্যবসা করা এক ব্যক্তির সাথে কথা হয় এসব নিয়ে। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্মৃতিতে পড়া ময়লা আবর্জনা ধুলো সরিয়ে বলতে থাকেন অনারগল। হালচিত্রও তার নখদর্পণে। বললেন, পুরোনো সেই পাপিরা না থাকলেও এখনও স্টেশনের আশপাশে মদের আসর আছে ঠিকই। তবে কতোটা অবৈধ মদের দোকান তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। মদের দোকানিরও অনেকটা ভ্রাম্যমাণ। গত বছরের নভেম্বরে সন্ধ্যার পর ডিবির অভিযান দেখে পালানোর সময় মদ বিক্রির বেঞ্চ থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায় শহিদুল ইসলাম। স্টেশনের ডাউন লাইনের অদূরে বস্তির পাশের রাস্তায় বেঞ্চটাই রাতে হয়ে যেতো দোকান। শহিদুলের মৃত্যুর পর রাস্তাটা মুক্ত হয়েছে। নারী-পুরুষ পথচারীরা এখন সন্ধ্যার পর অনেকটা নির্বিঘ্নেই চলাচল করে। অপরদিকে স্টেশনের স্টেডিয়াম প্রান্তে বিরু, জুলমত, গোবিন্দ ও শঙ্করসহ কয়েকজন দিব্যি মদ নিয়ে সন্ধ্যার পর ঘুর ঘুর করে। আর ভ্রাম্যমাণ? শিপু রাণীতো কতোবারই পত্রিকার পাতার খবর হলো। নিজে স্বীকারও করে সে পতিতা। পুলিশের এক সদস্য শিপুকে মেরে আহত করলেও রাতের রাণী এখন ওকেই বলতে হয়। স্টেশন বটতলার অদূরেই অবস্থান তার। কতো রকমই না খোদ্দের আসে। কে কোন রোগ ঢেলে রেখে যায়, আর কে নিয়ে যায় কোন মারণব্যাধি কে জানে? ওদের তো আর স্বাস্থ্য পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা নেই!

ভ্রাম্যমাণ পতিতাদের ওসবে পুলিশ বাধ সাধে না? খোদ্দেরদেরও কিছু বলে না? এসব প্রশ্ন করতেই স্টেশনের বাইরের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন তথ্যদাতা। স্মৃতির পাতা উল্টে বলছিলেন বেশ। পুলিশের কথা শুনেই দমে গেলেন। বললেন অতো-সতো জানি না বাপু। ঘড়ির কাঁটা ঠিক যখন ১২টা। শুরু হলো হাঁটা। চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনের মূল দরজাটা মূলত পশ্চিমপ্রান্তে। পূর্ব প্রান্তের প্লাটফরমের পরই আখ ক্রয়কেন্দ্রের আখ নেয়ার জন্য লাইন ছিলো। মালগাড়িও সেখানে রেখে খালাস করানো হতো। এখন সেই লাইন আছে নাকি নেই তা শাদা চোখে দেখে বোঝা মুশকিল। স্টেশন প্লাটফরমে প্রবেশ মুখেই কয়েকটি চা দোকান। প্লাটফরমে প্রবেশের টিকেট কেনা যাবে? এ কথা শুনে সকলেই হাসলেন। দেখালেন ওই টিকেট কাউন্টারের বন্ধ জানালা। প্লাটফরমে ঊর্ধ্বমুখি রেলের প্লাটফরমে কেউ কেউ বসে আছেন। অনেকেই রয়েছেন ভাড়ায় নেয়া পাটিতে শুয়ে। প্লাটফরমের উত্তরপ্রান্তে ঊর্ধ্বতন উপসহকারী (কার্য্য) কার্যালয়ের সামনে দু মাতাল। একজন মাটিতে লুটিয়ে। আর তার সহযোগী লুঙ্গি সামলাতেই হিমিশিম খাচ্ছে। একটু এগোলেই বটতলার রাস্তা। ওখানেই নাকি থাকে রাতের রাণী। গত মধ্যরাতে অবশ্য দৃষ্টিগোচর হয়নি। খোদ্দের নিয়ে আড়ালে নাকি অন্য কোথাও? জবাব মেলেনি। স্টেশনের দিকে ফিরতেই সামনে হাজির সফেদ পাঞ্জাবি পরা এক ব্যক্তি। সাধু সাজার প্রাণান্ত চেষ্টা। তিনি উচ্চ স্বরে বলতে শুরু করলেন, আমি কে-কেলে বাবু। তোরা কেকে মদ বিক্রি করিস সামনে আই। দেখি তোদের কতো বড় সাহস। মদ বিক্রেতাদের তেমন কাউকে অবশ্য সেখানে পাওয়া যায়নি। তবে কেলে বাবু বলে পরিচয় দেয়া ব্যক্তিও টলকাছিলেন মাতালের মতোই। প্লাটফরমের ওপরে অন্ধকারে বসে খাচ্ছিলেন খেচুড়ি। আলো জালতেই তিনি ছুটে চলে গেলেন অন্যদিকে। আরও বেশ ক’জন পাগলকে পাওয়া যায় সেখানেই। রেললাইন ডিঙিয়ে নিম্নমুখি রেল প্লাটফরমে। শুনশান নিরবতা। যাত্রী নেই। আছেন শুধু বেশ কয়েকজন শ্রমিক। এরা বগুড়া থেকে চুয়াডাঙ্গায় সিগন্যালের কাজ করার কাজে এসেছেন। স্টেশন প্লাটফরমটাই হয়েছে তাদের রাতের আশ্রয়স্থল। লম্বা লাইন দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা শ্রমিকদের পাশেই একজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেরে নিলেন মূত্রত্যাগের কাজ। ২ নং প্লাটফরমের অধিকাংশই অন্ধকারে ঢাকা। এরই এক প্রান্তে ঘুমিয়ে ছিলেন এক নারী। মধ্যবয়স পেরিয়েছে কবে শাদা চোখে দেখা মুশকিল। হাড্ডিসার নারীর পাশেই শুয়ে ছিলো একটি কুকুর। দৃশ্যটা কষ্টের হলেও কুকুর তাড়াতে গিয়ে বৃদ্ধার আরামের ঘুমটাই যদি ভেঙে যায়! আশঙ্কায় টু শব্দটিও আর করা হয়নি।

ওভারব্রিজের নিচ দিয়ে আবারও ১ নং অর্থাৎ ঊর্ধ্বমুখি ট্রেনের প্লাটফরমে ফিরতেই খুলনা থেকে ছেড়ে আসা সৈয়দপুরগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটি ৫ মিনিট বিলম্বে চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে পৌঁছুলো। ট্রেন থেকে প্রায় অর্ধশত ভ্রমণকারী নামলেন, উঠলেন স্টেশন প্লাটফরমে পাটিভাড়া নিয়ে বসে থাকা অপেক্ষমানদের প্রায় সকলে। সীমান্ত এক্সপ্রেস ছেড়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্টেশনে নেমে এলো অনেকটা নীরবতা। যে ক’জন প্লাটফরমে থেকে গেলেন তাদের অধিকাংশেরই নাষিকাগর্জন ছিলো রেকর্ড করার মতো। মধ্যরাতে স্টেশনের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে ঘুরতে দেখে স্টেশনে কুলিদের জন্য নির্ধারিত ঘরে শুয়ে বসে থাকা কয়েকজন তাকালেন আমাদের দিকে। এগিয়ে যেতেই পরিচয় দিয়ে কুলি সর্দ্দার শুকুর আলী বললেন, রাতে আমরা ৬-৭ জন ডিউটি করছি।

রাত যতোই গড়াতে লাগলো চুয়াডাঙ্গা স্টেশন প্লাটফরমও যেন ততোই রহস্যময় হয়ে উঠলো। কয়েকজন যুবকের প্রকাশ্যে ধূমপানের ধরন দেখে সামনে গিয়ে কথা বলার সাহসই হলো না। স্টেশনে জিআরপি ফাঁড়ি আছে। আছে জিআরপি সদস্যও। ফাঁড়ির দরজায় তালা ঝুললেও একজন কনস্টেবলকে অবশ্য চা দোকানে বসে খোশগল্পে মেতে থাকতে দেখা গেছে। স্টেশনের বিশ্রামাগার থাকলেও প্রথম শ্রেণিরটা তো খোলাই হয় না। অন্যগুলো? নাকে রুমাল দিয়ে ঢুকতে হয়। গতরাতে ওগুলো ঘুরে দেখতে গেলে একজন ঘুমের ঘোরে ঘোরেই যেন নিজের অজান্তে বলে ওঠেন, ওদিকে গন্ধ। এদিকে এসে পাটি নিয়ে বসুন।

উল্লেখ্য, বিচিন্তার একদল সংবাদকর্মী নব্বই দশকের প্রথম দিকে রাতের ঢাকা দেখতে বের হতেন কড়কড়ে মোরগের মতো মোটরবাইক নিয়ে। মাথাভাঙ্গার সংবাদকর্মীরা বাইক রেখে পায়ে হেঁটেই রাতের চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও ঝিনাইদহ দেখার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। আজ তারই প্রথম পর্ব।