রাতের কলেজ রোড : পর্যাপ্ত আলোর পরও গা ছমছম

 

উজ্জ্বল মাসুদ/রহমান রনজু: যদি প্রশ্ন করা যায়, কোন শহরে শেয়াল আর কুকুরের সহাবস্থান? একটু রাত হলেই যারা চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের রাস্তায় ঘোরেন তাদের এই প্রশ্নের জবাব দিতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হবে না। বৈরি সম্পর্কের উদাহরণ টানতে যখন সাপে নেওলে, শেয়াল-কুকুরে বলা হলেও চুয়াডাঙ্গার ক্ষেত্রে ওইসব প্রাণির ক্ষেত্রে অতোটা বৈরি সম্পর্ক এখন আর নেই। কামড়া-কামড়ির চেয়ে সম্প্রীতিই যে শ্রেয় তা ওরা বুঝে গেছে বলেই হয়তো চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের কলেজ রোডে ওদের অবাধ সহাবস্থান।

চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের সরকারি কলেজের সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া সড়কটির নাম যদিও শহীদ রবিউল ইসলাম সড়ক, তবুও কলেজ সড়ক নামেই বহুল পরিচিত। চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন থেকে কোর্টমোড় পর্যন্ত সোজা পিচঢালা রাস্তার প্রস্থও একেবারে কম নয়। এ সড়কের দুই ধারে মোট বৈদ্যুতিক খুঁটির সংখ্যা ৬৭টি। বেশির ভাগ খুঁটিতেই ঝুলছে বিজলিবাতি। এরপরও কেমন যেন গা ছমছম করা সড়ক। গতরাত ১২টার দিকে দৈনিক মাথাভাঙ্গা দফতর থেকে অর্থাৎ স্টেশনের নিকটস্থ চালপট্টির মাথাভাঙ্গা সড়ক থেকে দুজন সংবাদকর্মী রওনা হই। উদ্দেশ্য রাতের শহীদ রবিউল ইসলাম সড়ক দেখা।

সড়কের শুরুতেই গমপট্টি ও মাছের আড়তপট্টির মাঝে হরিজন সম্প্রদায়ের একটি পরিবারের বসবাস। ওখানে সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দেদারছে চলে মদের আসর। কেউ কেউ হেঁটে হেঁটেও মদপান করে। প্রকাশ্যে মাতলামিও এই স্থানে প্রায় প্রতিরাতের চেনা ছবি। গতরাত ১২টার দিকে যখন রাতের কলেজ সড়ক দেখতে বের হই, তখনও কয়েকজন মাতাল ঝিমুচ্ছিলো রাস্তার পাশে। কেউ কেউ বের হলো ওই বাড়ির ভেতর থেকে, দুইজন ঢুকলেন ভেতরে। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়াতেই একজন বললেন, দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে, লাগলে ভেতরে গিয়ে দাদা বলে ডাকলেই দিয়ে দেবে বাংলা। দাদা না থাকলে বৌদি বললেও সাড়া মেলে। না, আমাদের আর অতোটা ভেতরে যেতে হলো না। এক পা দু পা করে মাছের আড়তপট্টির গন্ধ পেরিয়ে জান্নাতুল মওলা কবরস্থানের উজ্জ্বল আলো মাড়িয়ে টিঅ্যান্ডটি অর্থাৎ বর্তমানের বিটিসিএল’র নিকট পৌঁছুতে চোখে পড়লো রাস্তার ওপর প্রায় হাফ ডজন কুকুরের আয়েশি অবস্থান। কুকুরগুলোর কাছে পৌঁছুতেই কয়েকটি উঠে আমাদের গন্ধ নেয়ার চেষ্টা করে ফের রাস্তার ওপরই শুয়ে পড়লো। টিঅ্যান্ডটির বিপরীতের পাবলিক লাইব্রেরির রাস্তা থেকে উঠে এলো শেয়াল। পণ্ডিতি আচরণ। রাস্তায় শুয়ে থাকা কুকুরগুলোর একটিও শেয়ালগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলো না। শেয়াল শেয়ালের মতো, আর কুকুর কুকুরের মতোই অবস্থান। ঈদগা মোড়ের গফুর স্টোর মোড়টাকে জাগিয়ে রাখে মধ্যরাত পর্যন্ত। গতরাতে যখন ওই মোড় অতিক্রম করি আমরা, তখন ওই দোকানেরও টানা হচ্ছিলো ঝাপ। পশুসম্পদ কার্যালয় পেরিয়ে কবরী সড়ক মোড়। সেখানেও কুকুর আর শেয়ালের সহাবস্থান। কুকুরগুলো শেয়ালের গন্ধে বিরক্ত না হলেও অজ্ঞাত কারণে আমাদের দেখে তেড়ে এলো। ছেই ছেই বলতেই নিবৃত হলো। তারপর একটু ভদ্র সেজেই কলেজ গেটের দিকে এগিয়ে আশে পাশে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করলাম, এতো রাতে অতো রাস্তা পায়ে হেঁটে পার হলাম, অথচ একজন নৈশপ্রহরীকেও তো চোখে পড়লো না। আর রাতে পুলিশি টহল? ডুমুরের ফুল। যদিও গতরাতে গণপূর্ত দফতরের সামনে পুলিশের কয়েকজন সদস্যের দেখা মেলে। ওই এলাকায় আসামি ধরার অভিযান চালিয়ে ওই পুলিশ দল ফিরছিলো বলে জানা গেলো। কলেজ রোডের হাসপাতাল মোড় অতিক্রমের পরই কাঠপট্টি। কাঠের গোলা বলে পরিচিত। এই এলাকার নৈশপ্রহরীদের কাছে নাকি রাতের রাণীরা থাকে। গতরাতে এক নৈশপ্রহরীর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে তিনি ইতস্ত করতে লাগলেন। বেফাঁস বলেই ফেলা হলো ভাই, কিছু নেই? নৈশপ্রহরী কাঠগোলার ভেতরের রাস্তা দেখিয়ে বললেন, ডানে যান, পাবেন। না, ডানে বামে গিয়েও সাড়া মিললো না। সময় স্বল্পতার কারণে কাঠগোলা থেকে ফিরে ফের রাস্তায় হাঁটা শুরু। পান্না সিনেমাহলের সামনে পর্যাপ্ত আলো থাকলেও মানুষ নেই। ইউপি চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশন হলচত্বরটা ভুরকুষ্ট অন্ধকার। প্রেসক্লাব পেরিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসের ছাউনিগুলোর দিকে লাইট মেরে বেশ কিছুক্ষণ সময় অবস্থান নিয়েও কারো সাড়া মিললো না। শোনা যায়, রাতে ওই চালার মধ্যে নাকি অনেক কিছুই হয়। জেলা প্রশাসকের বাসভবন পেরিয়ে জেলা জজ আদালতের পরই মোড়। এ মোড়ের শোভাবর্ধনে লাগানো হয়েছে দোয়েল পাখি। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে শুরু হলো দুইদল কুকুরের ভয়াবহ কামড়াকামড়ি। অগত্যা দ্রুত মোড় ত্যাগ করে সোজা মাথাভাঙ্গা অফিসের দিকে। ফেরার পথে টিঅ্যান্ডটি গেটের অদূরে টহল পুলিশের অটো। আমাদের থামিয়ে জানতে চাইলেন পরিচয়। দেখেই বললেন কোথায় গিয়েছিলেন? রাতের কলেজ রোড দেখে ফিরছি শুনেই জানতে চাইলেন কেমন দেখলেন? বললাম ভালোই তো মনে হলো।