রাজন হত্যার প্রধান আসামি কামরুলকে ফেরত আনা হলো: সিলেট আদালতে তোলা হচ্ছে আজ

 

স্টাফ রিপোর্টার: মানুষরূপী সেই দানব শিশু রাজনের খুনি কামরুল ইসলাম এখন পুলিশ হেফাজতে। খুন করেই সৌদি আরব পালিয়ে যাওয়া এই ঘাতককে গতকাল দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের একটি দল ইন্টারপোলের সহায়তায় রিয়াদ থেকে কামরুলকে দেশে ফেরত আনে।

পুলিশ জানিয়েছে, সৌদি কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে বিচারের মুখোমুখি করতে তাকে দেশে আনা হয়। দি আরবে পুলিশের হেফাজতে থাকা কামরুলকে আনতে সোমবার ভোরে রিয়াদে যান পুলিশ সদরের তিন কর্মকর্তা। গতকাল বিকালে আসামিকে নিয়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তারা ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। পরে সেখান থেকেই কামরুলকে নিয়ে যাওয়া হয় সিলেটে। আজ তাকে আদালতে হাজির করা হবে। ঘটনার দিন খুঁটির সাথে বেঁধে নির্মম নির্যাতন করা হয় শিশু সামিউল আলম রাজনকে। এক পর্যায়ে পানি খেতে চেয়েছিলো রাজন। ঘাতকদের একজন তাকে বলেছে, ‘পানি নাই, ঘাম খা’। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগ পর্যন্ত তাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়েছে। আর প্রচণ্ড উল্লাসে সেই মধ্যযুগীয় বর্বর ঘটনা ভিডিও করে তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয় দানবরা। সেই ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, নির্মম নির্যাতনের ঘটনাটি ঘটে এই কামরুলের নেতৃত্বে। তার পৈশাচিক নির্যাতনের দৃশ্য দেখে সারা দেশে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বিমানবন্দরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) এসপি রাশেদুল ইসলাম খান বলেন, দুপুর ২টা ৫৭ মিনিটে কামরুলকে নিয়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট বিমানবন্দরে পৌঁছায়। পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত সুপার মাহবুবুল করিম বলেন, ১২ জুলাই কামরুলকে সৌদি আরবের জেদ্দায় আটক করা হয়। প্রথমে তিনি কনস্যুলেটে ছিলেন। সর্বশেষ সৌদির রিয়াদ থানা থেকে পুলিশ তাকে বুঝে নিয়ে ঢাকায় আসে। এআইজি (গণমাধ্যম) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, সৌদি আরবের সাথে আমাদের কোনো বন্দিবিনিময় চুক্তি ছিলো না। তার পরও আমরা তাকে আলোচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনেছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কামরুলকে ফেরাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুরোধ করলে সৌদি কর্তৃপক্ষ তাতে সম্মত হয়। পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত সুপার মাহাবুবুল করিম, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ এবং সহকারী পুলিশ কমিশনার এএফএফ নেজাম উদ্দিন আসামি কামরুলকে আনতে সৌদি আরব যান।

সেদিন যা ঘটেছিল: রাজন। পুরো নাম শেখ সামিউল আলম রাজন। বাবা শেখ আজিজুর রহমান পেশায় একজন মাইক্রোবাসচালক। বাড়ি সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামে। দু ভাইয়ের মধ্যে রাজন বড়। অনন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা রাজন সবজি বিক্রি করতো। আর সবজি বিক্রির টাকা দিয়েই চলত রাজনের পরিবারের খরচ। ৮ জুলাই হত্যাকারীরা রাজনকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে খুন করে। আর পুরো ঘটনাটি তারা ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়। ওই ভিডিও ফুটেজ দেখে সারা দেশের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। ভিডিও ফুটেজে নির্মম সেই হত্যার ঘটনায় দেখা গেছে, কুমারগাঁও এলাকায় একটি দোকানের খুঁটির সাথে বেঁধে প্রায় আধা ঘণ্টা নির্যাতন করা হয় ১৩ বছরের শিশু রাজনকে। বাঁধা অবস্থায় পানির জন্য বেশ কয়েকবার আর্তনাদ করলেও রাজনকে পানি দেয়নি কামরুল ও তার সহযোগীরা। পানি চাইলে কামরুল তাকে বলেছে, ‘পানি নাই, ঘাম খা’। কয়েকজন মিলে উল্লাসের সাথে রাজনের ওপর চালায় অমানবিক নির্যাতন। টানা ২৮ মিনিট বাঁধা অবস্থায় অনেকটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চলে নির্যাতন। শিশুটি শরীরে টানা নির্যাতন সইতে না পেরে শেষে পানি খাওয়ার আকুতি জানায়। ভিডিওচিত্রে তিন-চার জনের কণ্ঠস্বর শোনা গেলেও ভিডিও ধারণকারী আরও দুজনের উপস্থিতিও দেখা গেছে। ‘এই ক (বল) তুই চোর, তোর নাম ক, লগে কারা আছিলো’ ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চেয়ে মারধর করা হয়। রাজনের নখে, মাথা ও পেটে রোল দিয়ে আঘাত করে এক সময় বাঁ হাত ও ডান পা ধরে মোচড়াতেও দেখা যায়। কয়েক মিনিটের জন্য রাজনকে হাতের বাঁধন খুলে রশি লাগিয়ে হাঁটতে দেয়া হয়। হাড়গোড় তো দেখি সব ঠিক আছে, আরও মারো বলে রাজনের বাঁ হাত খুঁটির সাথে বেঁধে রেখে আরেক দফা পেটানো হয়। এ সময় রাজনের শরীর ও চোখ-মুখ বেশ ফোলা দেখা গেছে। একপর্যায়ে মাটিতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে রাজন।

পুলিশ জানায়, চুরির অভিযোগ এনে কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড এলাকার বড়গাঁও সুন্দর আলী ও গাজী লালাই মিয়া মার্কেট সংলগ্ন স্থানে একটি খুঁটির সাথে হাত-পা বেঁধে টানা আধা ঘণ্টা ধরে মারধর করা হয় রাজনকে। তাদের পিটুনিতে মারা যায় রাজন। রাজন মারা গেছে বুঝতে পেরে তার লাশ গুমের চেষ্টা চালায় কামরুল ও সহযোগীরা। এ চেষ্টার সময় মুহিত আলম নামে একজনকে স্থানীয় লোকজন আটক করে পুলিশে দেন। পুলিশ ওই দিন দুপুরের দিকে রাজনের লাশ উদ্ধার করে। কামরুল পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে সৌদি আরব পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় রাজনের বাবা বাদী হয়ে জালালাবাদ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

এদিকে রাজনের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর সারা দেশে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। তখন প্রবাসীদের সহায়তায় কামরুলকে আটক করে সৌদি পুলিশে তুলে দেন বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা। এরপর কামরুলকে ফেরাতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ পুলিশ। জারি করা হয় রেড নোটিস।

রাজন হত্যাকাণ্ডের বিচার ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে সিলেটের আদালতে। গতকাল পর্যন্ত এ মামলায় ৩৫ জনের জবানবন্দি শুনেছেন আদালত। ঘটনার দেড় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে ১৬ আগস্ট ১৩ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিলেট মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সুরঞ্জিত তালুকদার। এরপর ২২ সেপ্টেম্বর আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আলোচিত এ হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১ অক্টোবর থেকে শুরু হয় সাক্ষ্য গ্রহণ। কামরুলকে নিয়ে এ মামলার আসামিদের মধ্যে ১১ জনকে গ্রেফতার করল পুলিশ। পলাতকদের মধ্যে কামরুলের ভাই সদর উপজেলার শেখপাড়ার বাসিন্দা শামীম আহমদের সাথে পাভেল আহমদ নামে আরেকজন রয়েছেন। কামরুলের আরেক ভাই মুহিত আলম এ মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। এআইজি নজরুল বলেন, ‘১৩ আসামির মধ্য ১১ জন গ্রেফতার হলেন। বাকি দুজনকে গ্রেফতারের প্রক্রিয়া চলছে।‘ পলাতক শামীম ও পাভেলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশিত হয়।

ছয় পুলিশ সদস্যের সাক্ষ্য গ্রহণ: রাজন হত্যা মামলায় গতকাল আরও ছয় পুলিশ সদস্যের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এ নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের ৩৮ সাক্ষীর মধ্যে ৩৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হলো। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আকবর হোসেন মৃধা পুলিশ সদস্যদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। রাজনের বাবার নিযুক্তীয় আইনজীবী শওকত চৌধুরী এ তথ্য জানিয়েছেন। সাক্ষ্য প্রদানকারী পুলিশ সদস্যরা হলেন জালালাবাদ থানার ওসি আখতার হোসেন, রাজন হত্যা মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা একই থানার বরখাস্তকৃত পরিদর্শক আলমগীর হোসেন, একই থানার এসআই আরিফুল আমিন, এসআই শামীম আকঞ্জি, এএসআই সোহেল রানা ও সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উপপরিদর্শক মহাদেব বাঁছাড়। আগামী রোববার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সুরঞ্জিত তালুকদারসহ অন্যদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে।