রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিদেশি ক্রেতারা আসছেন না : চলছে রাজনীতির কঠিন সময়

স্টাফ রিপোর্টার: হরতালসহ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিদেশি ক্রেতা বা তাদের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে আসতে আগ্রহ হারাচ্ছে। এতে রফতানি বাণিজ্যের সাথে সংশ্লিষ্টরা যেমন অসুবিধার মধ্যে পড়েছেন, সাথে সাথে দেশের তারকা হোটেলগুলোর ব্যবসাও কমছে। অপরদিকে চলতি নভেম্বর মাস দেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত ঘটনাবহুল বলে প্রতিপন্ন হবে বলে মন্তব্য করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল।

রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের পাশাপাশি দেশের সচেতন জনগোষ্ঠীর মধ্যে নভেম্বর নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, মাসটি দেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত কঠিনও। কারণ এ মাসের মধ্যেই নির্ধারিত হবে দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি। স্পষ্ট হবে, দেশ আসলে কোন দিকে যাচ্ছে। সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতার দিকে, নাকি সংঘাতের পথে?

জানা গেছে, সাধারণত এ সময়ে বিদেশি ক্রেতারা সারা বছরের অর্ডার দিয়ে থাকে। এজন্য ক্রেতা বা তাদের প্রতিনিধিরা বেশ কয়েকদিন বাংলাদেশে অবস্থান করে। এর মধ্যে তারা রফতানিকারকদের সাথে বৈঠকসহ তাদের কারখানা পরিদর্শন করেন। কিন্তু হরতাল, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্রেতারা এখন বাংলাদেশে আসতে চাইছেন না। জরুরি বৈঠক থাকলে ক্রেতারা রফতানিকারকদের তৃতীয় কোনো দেশে যেতে বলছেন। অধিকাংশ রফতানিকারক এখন তাদের ক্রেতাদের সাথে বৈঠকের জন্য হংকং, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, চীনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন।

নির্বাচন কেবল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট ও তাদের সমর্থকদের অংশগ্রহণে একতরফা হবে, নাকি সব দলের অংশগ্রহণে হবে তাও জানা যাবে এ সময়। নির্বাচনের তফশিলও এ মাসেই ঘোষণা করা হবে। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চূড়ান্ত মেরুকরণও এ মাসের মধ্যেই হতে পারে। পাশাপাশি নির্বাচন প্রশ্নে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিকমহল বা শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর সর্বশেষ অবস্থানও এ সময়ের মধ্যে বোঝা যেতে পারে। বিশেষ করে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রশ্নে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্বের মনোভাবও এ সময়ের মধ্যে স্পষ্ট হতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খানের মতে, সমঝোতার সুযোগ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। এটা আরও দেরি হলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে; যা দেশ এবং নাগরিকদের জন্য ভালো হবে না। তিনি বলেন, বড় দু দল সংঘাত এড়াতে চাইলে পথ বের করা কঠিন নয়। আর এ প্রক্রিয়া যতো তাড়াতাড়ি হবে, জটিলতা ততো কম হবে। তার মতে, একদলীয় নির্বাচন হলে দেশে প্রচণ্ড সংঘাত হবে; আর সব দলের অংশগ্রহণে হলে শান্তি ফিরে আসবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক আরেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান চলতি নভেম্বরকে অত্যন্ত ‘টাফ এবং ক্রিটিক্যাল’ টাইম হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এ মাসের মধ্যে দেশে ঘটন-অঘটন সবই হতে পারে। কারণ সমঝোতার সময় এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। তিনি বলেন, বড় দু দল এরই মধ্যে যে অবস্থান স্পষ্ট করেছে তাতে মনে হয় না তারা সমঝোতার দিকে যাবে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কার্যকর সংলাপের সুযোগ দ্রুতই কমে যাচ্ছে। কারণ জনস্বার্থ উপেক্ষা করে আমাদের নেতারা ক্ষমতার লড়াইয়ে উচ্চতর ঝুঁকি নিচ্ছেন। এর ফল ভালো হবে বলে মনে হয় না।

সমঝোতার সম্ভাবনা কমে গিয়ে নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার কারণেই নভেম্বরকে ঘিরে আলোচনা ও গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। দৃশ্যত সংলাপের প্রায় সব দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রধান দু দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট তাদের রাজনৈতিক অবস্থান অনেকটাই স্পষ্ট করেছে। বিএনপিকে ছাড়াই সর্বদলীয় সরকার গঠন তথা নির্বাচন করার মানসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একতরফা এ নির্বাচনে ঝুঁকি থাকলেও ক্ষমতাসীনরা তা বিবেচনায় নিতে চাইছে না। অন্যদিকে বিএনপি ওই নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। দু দলের মধ্যে ‘ছাড়’ দেয়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। কার্যত দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে দেশের রাজনীতি। আর এই দুই ধারার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্ত হচ্ছে ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র বলে পরিচিত বিভিন্ন শক্তি, সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী, এমনকি সমর্থক গোষ্ঠীও। অনেকের মতে, দেশি-বিদেশি কূটনীতিকরাও এ থেকে বাদ যাচ্ছেন না। সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি এক জটিল আকার ধারণ করেছে। বলা হচ্ছে, এ রকম বহুমাত্রিক সঙ্কট স্বাধীনতার পরে আর কখনোই হয়নি। সমাজে দেখা যায়নি এমন আশঙ্কাজনক বিভক্তি। বিদ্যমান এ সঙ্কট কোথা থেকে কোন দিকে মোড় নেয় তা নিয়ে অনেকেই শংকিত। তাই নভেম্বরকে ঘিরে সর্বত্রই এখন জল্পনা- কি হয়, কি হয়! সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ওই তারিখের মধ্যে নির্বাচন করতে হলে নভেম্বরের মধ্যেই তফসিল ঘোষণা করতে হবে। অথচ প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাথে সমঝোতা এখনও হয়নি। এমতাবস্থায় সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন করতে হলে তা একতরফাই করতে হবে। ফলে এক ধরনের ঝুঁকি থাকায় নির্বাচন কমিশন কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে।

পাশাপাশি তফশিল ঘোষণা করা হলে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও মহাজোটভুক্ত দল ছাড়া আর কারা ওই নির্বাচনে অংশ নেয় তাও দেখার বিষয়। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জেপি এরই মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার সিদ্ধান্তকে অনেকেই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন। নভেম্বরের মধ্যে সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর মেরুকরণও সুস্পষ্ট হবে।

একতরফা নির্বাচন হলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট অলআউট আন্দোলনে যাবে। আর এজন্য নভেম্বরেই রাজপথে তাদের শক্তি প্রদর্শনের শেষ সুযোগ। শেষ সুযোগ তাদের এ সময়ের মধ্যে সরকারকে তাদের চাপে ফেলার। কারণ নভেম্বরের পরের আন্দোলন হবে নির্বাচন প্রতিহত করার। ফলে বিরোধী জোটের আন্দোলন সরকার কিভাবে ট্যাকল করে তা নিয়ে নানামুখি আলোচনা ও শংকার কথা ছড়িয়ে পড়ছে। ওই পরিস্থিতিতে নভেম্বরে ব্যাপকভাবে সংঘাত ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নির্বাচনী সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশের এ সঙ্কট থেকে এবার দূরে থাকতে পারেননি দেশি-বিদেশি কূটনীতিকরাও। প্রকাশ্যে তারা প্রতিদিনই সমঝোতার তাগিদ দিচ্ছেন। শক্তিশালী কয়েকটি দেশের মধ্যে এ বিষয়ে মতদ্বৈততার কথাও শোনা যায়। তবে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না হলে ওই নির্বাচন স্বীকৃতি পাবে কি না তা নির্ভর করছে দেশগুলোর পক্ষ থেকে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পাঠানো বা না পাঠানোর সিদ্ধান্তের ওপর। এ বিষয়টিই কোনো দল বা সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগে তাদের হাতের সর্বশেষ কার্ড বা অস্ত্র। বলা হচ্ছে, সমঝোতা করতে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো ওই কার্ডই ব্যবহার করবে।

সূত্র মতে, এ প্রশ্নে কয়েকটি দেশের মানসিক প্রস্তুতির কথা জানা গেছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তারা এ মাসে ঘোষণা করবেন। আর এমন সিদ্ধান্তের প্রশ্নে তাদের মনোভাব বোঝা যাবে। সূত্র মতে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের পক্ষ থেকে এমন সিদ্ধান্ত তাদের পক্ষে নেয়ার চেষ্টা চলছে।