স্টাফ রিপোর্টার: যুবলীগ নেতা নিহতের জেরে রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলা সদরে পাহাড়িদের কয়েকশ বাড়িঘর আগুনে জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনায় ৬ জনকে আটক করেছে পুলিশ। আকটকৃতরা হলেন লংগদুর বাইট্যাপাড়ার মো. শরীফ (৩২), আবুল খায়ের (২৮), মুসলিমপাড়ার মোক্তার আহমদ (৩০), মাইনি এলাকার দেলোয়ার হোসেন (৩৯), জাকির হোসেন (২৬) ও নূর মোহাম্মদ (২৯)। গতকাল শুক্রবার লংগদু উপজেলা সদরে নিহতের লাশ নিয়ে বের করা মিছিল থেকে স্থানীয় পাহাড়িদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। আগুনে পাহাড়িদের প্রায় তিন শতাধিক বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সন্ধ্যায় লংগদু উপজেলা সদর ও মাইনিমুখ এলাকা থেকে ওই ৬ জনকে আটক করা হয় বলে জানান লংগদু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোমিনুল হক। ওসি জানান, আটককৃতদের মধ্যে ৪ জন লংগদু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন এবং ২ জনকে থানা হেফাজতে রাখা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে। মামলার পর তাদেরকে রাঙ্গামাটি আদালতে চালান দেয়া হবে।আগুন লাগানো বাড়ি-ঘরের বাসিন্দারা অন্যত্র অবস্থান নিয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে লংগদু উপজেলা প্রশাসন ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে। সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত বৃহস্পতিবার লংগদু উপজেলা থেকে ভাড়ায়চালিত মোটর সাইকেলের চালক ও স্থানীয় সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন দুইজন যাত্রী নিয়ে দীঘিনালার উদ্দেশ্যে রওনা হন। দুপুরের পর দীঘিনালার চারমাইল এলাকায় তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকজন পুলিশকে খবর দেন। পরে ওইদিন সন্ধ্যায় ফেসবুকে নয়নের মৃতদেহের ছবি দেখে তাকে সনাক্ত করে পরিবার ও বন্ধুরা।
গতকাল শুক্রবার সকালে নয়নের লাশ লংগদুতে তার গ্রামের বাড়ি বাইট্টাপাড়ায় আনা হয়। সেখান থেকে লংগদুবাসীর ব্যানারে প্রায় আট হাজার বাঙালির একটি শোক মিছিল উপজেলা সদরের দিকে যাচ্ছিলো জানাজার উদ্দেশ্যে। হঠাত একই উপজেলার ঝর্ণাটিলা এলাকায় মারফত আলী নামের এক বাঙালির বাড়িতে দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়েছে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ লোকজন প্রধান সড়কের পাশের লংগদু উপজেলা জনসংহতি সমিতির কার্যালয় সহ আশেপাশের পাহাড়িদের বাড়িঘরে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ শুরু করে। আগের দিন রাতেই স্থানীয় পাহাড়িরা সম্ভাব্য গোলযোগের আশংকায় বাড়িঘর থেকে সড়ে পড়ায় কোন হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও পাহাড়ি অধ্যুষিত তিনটিলা পাড়ায় ব্যাপক অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরে লংগদু সেনাজোন থেকে বিপুল সংখ্যক সেনা সদস্য মোতায়েন হলে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে।
পরে উপজেলা পরিষদ মাঠে নয়নের জানাজা ও শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। শোকসভায় বক্তব্য রাখেন উপজেলা চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন, জেলা পরিষদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো: জানে আলম, পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি আলমগীর হোসেন, উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম, সমঅধিকার নেতা অ্যাডভোকেট আবছার আলী।
বক্তব্য প্রদানকালে সেনাবাহিনীর লংগদু জোন কমান্ডার লে. কর্নেল আব্দুল আলীম চৌধুরী ও লংগদু থানার অফিসার মোমিনুল ইসলাম সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান এবং নয়নের খুনিদের গ্রেফতারের আশ্বাস দেন। লংগদু উপজেলা সমঅধিকার আন্দোলনের সভাপতি খলিলুর রহমান বলেন, আমরা লংগদুবাসীর ব্যানারে সর্বদলীয়ভাবে জানাজার জন্য উপজেলা সদরের মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাত্ খবর আসে ঝর্ণাটিলায় একটি বাঙালি বাড়িতে অগ্নিসংযোগের খবর আসে। এরপরই ঘটনা নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। তিনটিলা এলাকার বাসিন্দা ও উপজেলা জনসংহতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিশংকর চাকমা জানিয়েছেন, আমাদের পাড়ার একটি ঘরও অবশিষ্ট নেই। দুই শতাধিক বাড়িঘর সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে বলে তিনি দাবি করেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৯ সালে এই তিনটিলা এলাকায় তত্কালীন উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশীদকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এরপর বিক্ষুদ্ধ লোকজন এই পাড়ায় ব্যাপক অগ্নিসংযোগ করেন এবং ওই এলাকার পাহাড়িরা দীর্ঘদিন ভারতে উদ্বাস্তু হিসেবে ছিলেন এবং ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর দেশে ফেরত আসেন।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান জানিয়েছেন, ‘আমি বিষয়টি জানার সাথে সাথেই লংগদু উপজেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছি। আইনশৃংখলা পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক আছে এবং আইনশৃংখলাবাহিনী সর্বোচ্ছ সতর্কবস্থায় আছে।’ ঘটনার পর দুপুরে লংগদু উপজেলা সদর এলাকায় প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সেনাবাহিনীর লংগদু জোন কমান্ডার লে. কর্নেল আ. আলীম চৌধুরী, রাঙামাটির ডিডিএলজি প্রকাশ কান্তি, লংগদু উপজেলা চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন, লংগদু উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(বিশেষ শাখা) সাফিউল সারোয়ার, আদ্রকছড়া ইউপি চেয়ারম্যান মঙ্গল কান্তি, লংগদু ইউপি চেয়ারম্যান কুলীন মিত্র আদু ও লংগদু থানার ওসি মমিনুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে পাহাড়ি ও বাঙালিদের সহবস্থান নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্থদের একটি তালিকা করে তাদের দ্রুত ক্ষতিপূরুণ নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এদিকে যুবলীগ নেতা নয়নকে হত্যার প্রতিবাদে রাঙামাটি জেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ এবং পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ। দুপুরে শহরের বনরূপা থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে বনরূপায় এসে সমাবেশ করে।
জেলা যুবলীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সম্পাদক নুর মোহাম্মদ কাজলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ছাওয়াল উদ্দিন, পৌর যুবলীগের সভাপতি আবুল খায়ের, জেলা মত্সজীবি লীগের সভাপতি উদয়ন বড়ুয়া, কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক উদয় শংকর চাকমা। সমাবেশ থেকে অবিলম্বে পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করার আহবান জানানো হয়। দ্রুত নয়নের হত্যাকারীদের গ্রেফতারের জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়, অন্যথায় কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।
একই ঘটনার প্রতিবাদে শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ। শহরের কাঠালতলি থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বনরূপায় সমাবেশ করে। জেলা সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন সিনিয়র সভাপতি হাবিবুর রহমান, পার্বত্য নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক নূরজাহান বেগম, তুহিন প্রমুখ।