মোবারকের ফাঁসির আদেশ ৩৩ জনকে হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ

 

স্টাফ রিপোর্টার: মুক্তিযুদ্ধকালে ৩৩ জনকে হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা মো. মোবারক হোসেনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়েছেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া আবদুল খালেক নামে এক ব্যক্তিকে অপহরণ করে হত্যার দায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। রাজাকার মোবারকের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে দুটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে এ শাস্তি দেয়া হয়েছে। বাকি তিনটি প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে এসব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। মৃত্যুদণ্ডের আদেশ কার্যকর হলে স্বাভাবিকভাবে তার যাবজ্জীবনের শাস্তি একীভূত হয়ে যাবে। গতকাল সোমবার এ রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এই ট্রাইব্যুনালের অপর দু সদস্য হলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক।

মোবারক হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান বলেন, মৃত্যুদণ্ডের রায়ে আমরা খুশি। কিন্তু তিনটি অভিযোগে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। রায় পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে রায়ে ন্যায় বিচার হয়নি দাবি করে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। মোবারকের আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, তিনি মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার মতো কোনো অপরাধ করেননি বলে আমরা মনে করি। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের বক্তব্যের বৈপরীত্যই বলছে তারা সত্য বলেননি। আদালত এই সাক্ষীদের বক্তব্য সত্য ধরে নিয়ে রায় দিয়েছেন। রায় ঘোষণার অল্প কিছুক্ষণ আগে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় আনা হয় মোবারককে। সংক্ষিপ্ত রায় পড়ার পুরো সময়টা তাকে শান্ত দেখা গেছে। রায় ঘোষণার পরও তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি।

উল্লেখ্য, ট্রাইব্যুনালে এ প্রথম আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে অতীতে জড়িত কাউকে বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। গত ২ জুন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে ট্রাইব্যুনাল-১। প্রায় ছয় মাস পর গতকাল এ মামলার রায় ঘোষণা করা হলো। এটি হলো যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর ষষ্ঠ ও দু ট্রাইব্যুনালের ত্রয়োদশ রায়। সবশেষ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১ এর রায়ে ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র ও বিএনপি নেতা পলাতক এমএ জাহিদ হোসেন ওরফে খোকন রাজাকারের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। বর্তমানে দুই ট্রাইব্যুনালে আরো দুটি মামলার রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ রয়েছে।

গতকাল মোবারক রাজাকারের রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনালসহ সুপ্রিম কোর্টের আশেপাশের এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। ট্রাইব্যুনালে বিপুলসংখ্যক পর্যবেক্ষক এবং বাইরে বিক্ষুব্ধ কোন সংগঠনের মিছিল কিংবা সমাবেশও চোখে পড়েনি। এজলাস কক্ষও জনাকীর্ণ ছিলো না। এর আগে গত ১৩ নভেম্বর পলাতক খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণার দিনও একই ধরনের পরিস্থিতি দেখা গেছে।

গতকাল সকাল ১১-১০ মিনিটে কাঠগড়ায় আনা হয় মোবারক হোসেনকে। এরপর সোয়া ১১টার দিকে এজলাসে আসন গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল-১’র বিচারকরা। রায় ঘোষণার আগে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম দুই পক্ষের আইনজীবী ও উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আদালতের কার্যক্রম নিয়ে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে আরো সচেতন থাকতে হবে। আদালতে কোন বিষয় যে অবস্থায় থাকে, সেই অবস্থা নিয়েই রিপোর্ট হওয়া উচিত। এরপর ৯২ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ তিন বিচারপতিই পড়ে শোনান। সবশেষে দোষী সাব্যস্তকরণ ও সাজার আদেশ ঘোষণা করেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।

৩৩জনকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড: মোবারকের বিরুদ্ধে এক নম্বর অভিযোগে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২২ আগস্ট মোবারক ও অন্য রাজাকারেরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থানার টানমান্দাইল গ্রামের ২৬ জন ও জাঙ্গাইল গ্রামের সাতজনকে বাছাই করে তেরোঝুড়ি হাজতখানায় নিয়ে যান। ২৩ আগস্ট পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা ওই ৩৩ জনকে নিয়ে গঙ্গাসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ে গুলি করে খুন করে মাটিচাপা দেয়। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য ও তথ্যে এই অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর ৩(২)এর (এ)(জি)(এইচ) ধারায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এই অপরাধে ট্রাইব্যুনাল সর্বসম্মতিতে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দেন।

আবদুল খালেক হত্যায় যাবজ্জীবন: তিন নম্বর অভিযোগে মোবারককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১১ নভেম্বর রাত আটটা-নয়টার দিকে মোবারক তার সশস্ত্র রাজাকার সহযোগীদের নিয়ে ছাতিয়ান গ্রামের আবদুল খালেককে অপহরণ করে সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান ও শারীরিক নির্যাতন করেন। ওই রাতেই খালেককে তিতাস নদীর পশ্চিম পাড়ে বাঁকাইল ঘাটে নিয়ে গুলি ও বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুন করা হয়। এ অভিযোগও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল সর্বসম্মতিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। তিন অভিযোগে খালাস

রাষ্ট্রপক্ষের আনা দুই, চার ও পাঁচ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মোবারককে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুই অভিযোগ ছিলো আনন্দময়ী কালীবাড়ী মন্দিরের মূর্তি ভাঙচুর ও মালামাল লুট এবং আশুরঞ্জন নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে খুনের। চার নম্বর অভিযোগ হলো, মোবারকের নেতৃত্বে রাজাকারের একটি দল খড়মপুর গ্রামের খাদেম হোসেন খানকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার স্টেশন রোড থেকে অপহরণ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে স্থাপিত সেনাক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করে। পরে আরো কয়েকজন বন্দীর সঙ্গে তাকেও কুড়লিয়া খালের পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা ।

এক নজরে মোবারকের মামলা: গত বছরের ২৩ এপ্রিল মোবারকের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ১২ জন সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দেন মোবারক ও তার ছেলে। পরে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে ২ জুন মামলার কার্যক্রম শেষ হয়।

এর আগে ২০০৯ সালের ৩ মে মোবারকের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানায় মামলা করেন একাত্তরের শহীদ আবদুল খালেকের মেয়ে খোদেজা বেগম। মোবারক হাইকোর্ট থেকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান। পরে স্থানীয় আদালত এই মামলা ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করে। পরে মোবারকের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষ তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। ১২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নিয়ে মোবারকের জামিন বাতিল করে তাকে কারাগারে পাঠায়। এরপর থেকে তিনি কারাবন্দী রয়েছেন।