মোটাতাজাকরণে ১০ হাজার কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা

 

চুয়াডাঙ্গায় প্রস্তুত প্রায় ৬৫ হাজার গরু

আলম আশরাফ:গরুরমোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়া চলছে আসন্ন কোরবানির ঈদ সামনে রেখে। এ সময় দেশে কয়েক কোটিগরুসহ গবাদিপশু বেচাকেনা হয়। চুয়াডাঙ্গায় এবার প্রায় ৬৫ হাজার গরু স্থানীয়ভাবে মোটাতাজাকরণ করা হচ্ছে। খামার ও কৃষকের বাড়িতে এসব গরু মোটাতাজা করে আসন্ন কোরবানির ঈদ সামনে নিয়ে পশু হাটগুলোতে তোলা হবে। কেউ কেউ বাড়ি থেকে বিক্রি করলেও গ্রামের অনেকেই রয়েছেন যারা সঙ্ঘবদ্ধভাবে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে নিয়ে বিক্রি করবেন। যদিও গতবারের ঢাকায় কোরবানির হাটে গরু নিয়ে অনেকেই গরু ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হন। কারো কারো গুনতে হয়েছিলো মোটা অঙ্কের লোকসান।

পরিসংখ্যানে জানা যায়,দেশেকোরবানির ঈদে চাহিদারয়েছে প্রায় ৭৫ লাখ। এর এক-চতুর্থাংশই আসে স্থানীয়ভাবে গরু মোটাতাজাকরণপ্রকল্প থেকে। গড়ে ৪০ হাজার টাকা হিসেবে মোট বাণিজ্য হবে প্রায় ৩০ হাজারকোটি টাকা। যার মধ্যে মোটাতাজাকরণ খাতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।ঈদে ক্রেতাদের চাহিদার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দেখতে সুন্দর ও মোটাতাজা,পুষ্ট গরু,ভালো রং ও পুষ্ট শারীরিক গঠনের একেকটি গরুর দাম উঠে লাখ টাকারওপরে। এসব গরু চাহিদাও বাড়ছে। আর এ বিপুল চাহিদাকে সামনে রেখে দিন দিনজনপ্রিয় হচ্ছে গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প। স্বল্প সময়ে বেশি লাভেরদিকটিবিবেচনায় নিয়ে অনেক বেকার তরুণই গরু মোটাতাজাকরণের দিকে ঝুঁকছেন। অনেকেইপারিবারিক ব্যবসা বা স্থায়ী ব্যবসা হিসেবে নিচ্ছেন এটিকে।

সূত্র জানায়,আসছে কোরবানি ঈদে সারাদেশে প্রায় পৌনে ২ কোটি পশুর চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ৭৫ লাখেরবেশি গরু। ছাগলের চাহিদা ১ কোটি। পাশাপাশি মোষ,ভেড়া,দুম্বা ও উটেরচাহিদাও রয়েছে সীমিত আকারে। চাহিদার একটি বড় অংশ,বিশেষ করে গরুর চাহিদা মেটাতে ভারতনির্ভরতা রয়েছে।তবে দেশে পালিত এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত স্বাস্থ্যবান গরুর কদর দিন দিনবাড়ছে। এতেই পরিধি বাড়ছে গরু মোটাতাজাকরণের। মূলত চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া এ জেলাগুলো গরুর জন্য বিখ্যাত। মোটাতাজাকরণেরবেশিরভাগ গরুই আসে এসব জেলা থেকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,গত কয়েক বছর কোরবানির মরসুমে পশু বিক্রি করে লাভবান হওয়ায় অনেকেরই পশু পালনে আগ্রহ বেড়েছে। তবে গোখাদ্যের দাম বেশি হওয়ায়তাদের খরচ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তাদের মধ্যে। তাছাড়া শেষ মুহূর্তেভারতীয় গরুর আধিক্যে আশঙ্কাও তাদের উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।গবাদিপশু উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্রভূমিখ্যাত চুয়াডাঙ্গায় ব্যাপকহারে চলছেগরু মোটাতাজাকরণ। এ জেলায় প্রায় ৬০-৬৫ হাজার গরু মোটাতাজাকরণেরকাজ চলছে। এতে কৃষককে সহায়তা দিচ্ছে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ বিভাগসংশ্লিষ্টরা। তবে স্থানীয় কৃষকদেরঅভিযোগগোখাদ্য এবং ওষুধের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে। কোনো কোনো ওষুধের দামবেড়েছে তিনগুণ।

কুষ্টিয়া জেলায়ও এ বছর প্রায় ৫০ হাজার গরু মোটাতাজাকরণের কাজ চলছে। একই পরিমাণ কাজ চলছে মেহেরপুর ও ঝিনাইদহ জেলায়।পযুক্ত প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অভাব,গোখাদ্যের দাম বৃদ্ধি ও ভারতীয় গরুঅবাধে বাজারে আসায় ক্ষতির শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন কৃষক ও খামারিরা। তারাজানান,খরচ অস্বাভাবিক বাড়ায় গরু লালন-পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অনেকেপরপর কয়েক বছর আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।তারা এ ব্যাপারে সরকারের নজরদারি দাবি করেছেন।

চুয়াডাঙ্গা প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, জেলার ৪টি চুয়াডাঙ্গা জেলায় মোট ডেইরি খামার আছে ৪০৩টি। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১০৩টি, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ১৭৪টি, দামুড়হুদা উপজেলায় ১০৪টি ও জীবননগর উপজেলায় ২১টি খামার আছে। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন গ্রামের কৃষকরা গরু মোটাতাজাকরণ করছেন।

আলমডাঙ্গা উপজেলায় গরুমোটাতাজাকরণ সবচেয়ে বেশি হয়। উপজেলারনাগদাহ, আইলহাস, খাসকররা, জামজামি, হারদী, জেহালা, বেলগাছি ও ডাউকি ইউনিয়নে এ বছর প্রায় ১৫হাজার গরুমোটাতাজাকরণ করা হচ্ছে। খামারিরা জানান,৬০-৯০ হাজার টাকা দিয়ে বাজার থেকে এঁড়ে বাছুরকিনে প্রায় ৫০-৬০ হাজার টাকার খাদ্য খাওয়ানোর পর সেই ষাঁড় বিক্রি করতে হয় ২থেকে আড়াই লাখ টাকায়। এই কাজে সারা বছর কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। তবে ঈদেরসময় যদি অবাধে ভারত থেকে গরু আসতে থাকে তাহলে পোষা গরুর আর কদর থাকে না।তখন ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।স্থানীয় গরু ব্যবসায়ী মকবুল হোসেন ও জাহাঙ্গীর সরদার জানান,একসময় এ এলাকারমানুষ গরু মোটাতাজাকরণ করে অনেক পয়সা আয় করেছি। কিন্তু এখন ভারতের গরুআমদানি হওয়ায় আসল পুঁজি রক্ষাই দায় হয়ে পড়েছে।

প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্টারা বলছেন,মোটাতাজাকরণের জন্য পুষ্ট দেশি জাতের ষাঁড়সবচেয়ে ভালো। ভালোভাবে যত্ন নিতে পারলে এতে প্রায় শতভাগ লাভ করা যায়। গমেরভুসি,খেসারি,মসুর ডাল,ছোলা,ঝোলাগুঁড়,বিট লবণ ও খড় ইত্যাদি মিলিয়েপ্রতিটি গরুর জন্য দিনে প্রায় ১০০-১৫০ টাকা ব্যয় হয়। এ-সলভেট,ভিটামিন এডি এবং ইক্যাটাসল,ক্যাটাফস,মেটাফস,মেগাভিট ডিভি,অ্যানারেকসনবৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত ও স্বীকৃত বিভিন্ন ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ীব্যবহার করলে তিন মাসেই গরু মোটা হতে পারে। এতে ২০-২৫ হাজার টাকার প্রতিটিগরু ৩-৪ মাস পালন করে খরচ বাদে প্রায় সমপরিমাণ টাকা আয় করা যায়। ওষুধগুলোমানবদেহ বা গরুর জন্যও ক্ষতিকর নয়। এগুলো হজম এবং পশুর পেশি গঠনে সহায়তাকরে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন,অতিরিক্ত লাভের আশায় কিছু কিছু খামারি চিকিৎসকের পরামর্শছাড়াই নিষিদ্ধ দ্রুত বর্ধনশীল ট্যাবলেট গরুকে খাওয়াচ্ছে। এত অনেকক্ষেত্রেই হিতে-বিপরীত হচ্ছে। গরু খুবই কম সময়ে মোটা হলেও বিভিন্ন পেশিছিঁড়ে পানি জমে হঠাত গরু মারা যায়। ফলে কৃষক ক্ষতিতে পড়েন। এক্ষেত্রেস্থানীয় প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তাদের সহায়তা নেয়ার কথা বলে দেনবিশেষজ্ঞরা এবং তাদের কথা ছাড়া কোনো ধরনের ওষুধ গরুকে না খাওয়ানো বা কোনোইনজেকশন না দেয়ার পরামর্শ দেন তারা। তাছাড়া এতে প্রশিক্ষিতরা যদি গরুকেনিয়মিত পরিচর্যা করেন তাহলে লাভবান হওয়া যায় খুবই সহজে। ভারতীয় গরু আমদানিনিষিদ্ধ করে সরকারিভাবে সহায়তা করলে গরু মোটাতাজাকরণে খামারিরা স্বল্প সময়েঅধিক লাভবান হবে। তাই এই খাতকে নজরে রাখা দরকার বলে মনে করেন তারা।

এদিকে দেশের গরুর স্বল্পতায় প্রতি বছর ভারত থেকে প্রায়৪ হাজার কোটি টাকামূল্যের ৯০ লাখ থেকে ১ কোটি গরু বাংলাদেশে পাচার হয়। তবে এদেশের বাজারে তারদাম প্রায় ১০ গুণ। কেননা ভারতে যে গরুর দাম ৫০০ থেকে ৩ হাজার রুপি সেই গরুরদাম বাংলাদেশে ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার বেশি। প্রতিদিন ভারত থেকে ২০হাজার থেকে ২৫ হাজার গরু বাংলাদেশে পাচার হয়ে আসে।