মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে সক্রিয় ৩০ জন দালাল : জিম্মি রোগী

মেহেরপুর অফিস: মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতাল ঘিরে অন্তত ৩০ জনের একটি দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব দালালের হাতে জিম্মি রোগী ও তাদের স্বজনেরা।

হাসপাতালসূত্রে ও রোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে দালালদের উৎপাত নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। হাসপাতালে গেলেই চোখে পড়ে দালালদের রোগী নিয়ে টানাটানির দৃশ্য। তাদের বাধা টপকে হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে কোনো রোগীর পৌঁছুনো কষ্টের ব্যাপার। জোর করেই তারা রোগীদের নিজেদের পছন্দের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে নিয়ে যেত চায়। আর রোগীরা কোনোমতে সরকারি এই হাসপাতালের চিকিৎসকের কক্ষে পৌঁছুলেও নিস্তার নেই। চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হলে আরেক দফা টানাটানি শুরু হয়। এবার টানাটানি ব্যবস্থাপত্রে লেখা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। দালালদের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হবে।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা প্রসূতি আকলিমা খাতুন বলেন, তিনি মা ও প্রসূতি সেবা ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু এই হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে অনেক দেরি হবে এমন কথা বলে হাসমত আলী নামের এক ব্যক্তি তাকে পাশের একটি ক্লিনিকে নিয়ে যান। তখন বলা হয়েছিলো, ওই ক্লিনিকে তার স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্মদানের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু ভুলিয়ে-ভালিয়ে সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর অস্ত্রোপচার (সিজারিয়ান অপারেশন) করানো হয়। এ জন্য ১০ হাজার টাকা গুনতে হয়েছে তাকে।

১ জুন থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহ মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতাল ও আশপাশের এলাকা ঘুরে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে এসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। হাসপাতালে ঢোকার প্রধান ফটকে আটটি ওষুধের দোকান ও চারটি পানবিড়ির দোকান রয়েছে। দালাল চক্রের সদস্যরা এসব দোকানে শকুনির দৃষ্টি নিয়ে বসে থাকে। রোগী আসামাত্র তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে।

হাসপাতালের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল দালাল চক্রটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চাইলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। মাঝেমধ্যে চিকিৎসকেরা দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে তাদের রোষানলে পড়তে হয়।

মূলত এসব দালালকে নিযুক্ত করে আশপাশের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর কর্তৃপক্ষ। তাদের সাথে হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ থাকে। হাসপাতালের এমন অন্তত তিনজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম পাওয়া গেছে। তাদের একজন অফিস সহকারী শাহ আলম। অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে তার মুঠোফোন নম্বরে ফোন দেয়া হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর একাধিকবার ফোন দিয়ে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের আশপাশে আটটির বেশি বেসরকারি ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। এসব ক্লিনিকে সাধারণত মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকেরাই সেবা দেন। সেখানে রোগীদের কাছ থেকে ৩০০-৫০০ টাকা ভিজিট নেন তারা। এমন একটি ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা একজন রোগীর স্বজন আহমদ হোসেন বলেন, হাসপাতালের চেয়ে ভালো সেবা পাওয়ার কথা বলে এক ব্যক্তি তাদের এই ক্লিনিকে নিয়ে আসে। তবে এসে দেখতে পান হাসপাতালে যে চিকিৎসকের কাছে তারা চিকিৎসা করাচ্ছিলেন, এখানেও সেই একই চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন। পাশাপাশি এসব ক্লিনিকে রয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা, যদিও তার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আবার দালাল চক্রের হস্তক্ষেপে রোগীদের অনেক অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাতে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমন ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের একজন মেহেরপুর সদর উপজেলার গোভিপুর গ্রামের মিনহাজ আলী। তিনি বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তাকে একজন দালাল ভালো চিকিৎসার নাম করে বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যায়। মিনহাজকে সাতটি পরীক্ষা করাতে বলা হয়। কিন্তু পরে দেখা যায়, তার রোগটা তেমন কিছুই নয়, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা রয়েছে। এতটুকু ধরতেই মিনহাজের ৪ হাজার ৩০০ টাকা ব্যয় হয়ে যায়।

জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. মিজানুর রহমান বলেন, এটি সঠিক যে দালাল চক্র এখানে সক্রিয় আছে। তবে বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের সহযোগিতায় দালালবিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। এর মাধ্যমে অনেককে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। তারপরও দালালদের উৎপাত বন্ধ করা যায়নি। হাসপাতালটি সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা গেলে দেখা যেতো, কারা রোগীদের প্রতারিত করছে। এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।