মেহেরপুর গাংনীর পল্লী ষোলটাকা গ্রামে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে নৃসংশতা- প্রকাশ্যে দিবালোকে ইউপি সদস্য কামালকে কুপিয়ে খুন

 

গাংনী প্রতিনিধি: মেহেরপুর গাংনী উপজেলার ষোলটাকা গ্রামের ইউপি সদস্য কামাল হোসেনকে (৪২) কুপিয়ে খুন করেছে প্রতিপক্ষের লোকজন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বাড়ির অদুরে হামলা চালিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হামলায় আহত হয়েছেন কামাল হোসেনের ভাই কফেল উদ্দীন (৪৮)। এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

নিহত কামাল হোসেন ষোলটাকা গ্রামের মৃত আব্দুস সাত্তারের ছেলে ও ষোলটাকা ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ড সদস্য। হামলকারী মাজেদুল ইসলাম নিহত কামাল হোসেনের বড় ভাইয়ের জামাতা হলেও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিলো না।

শ্বশুর-জামাতা সম্পর্ক সম্মানের ও শ্রদ্ধার। শ্বশুর যেমনি জামাতাকে স্নেহ ও সম্মান করেন তেমনি জামাতারাও শ্বশুরকে শ্রদ্ধায় দেখেন। এমন রীতি হয়তো পৃথিবীর শুরুতেই। কিন্তু মাজেদুলের মধ্যে সেই সম্মানবোধ কিংবা শ্রদ্ধাভক্তি ছিলো না। শ্বশুর ও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্ক ছিল দা-কুমড়ো। এক পর্যায়ে তা রক্তক্ষয়ী জীবননাশের ঘটনায় ঠেকেছে বলে মন্তব্য করলেন গ্রামবাসী। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এলাকাজুড়ে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। মাজেদুলের বিভিন্ন অপকর্মের বর্ণনা দিয়ে সর্বোচ্চ সাজা দাবি করলেন ভুক্তভোগীরা।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চাঁদার দাবিতে গ্রামের একটি পুকুরে বিষ প্রয়োগ করে মাছ নিধন, রেওয়াজ করা দেড় কাঠা জমি ও গেলো ইউপি নির্বাচন নিয়ে কামাল হোসেনের পরিবারের সাথে মাজেদুলের বিরোধ সামনে আসে। এর জের ধরে বুধবার রাতে শ্বশুর আব্দুল হান্নান (কামালের বড় ভাই) অপদস্থ করে মাজেদুল ও তার পক্ষের লোকজন। কিন্তু এতেই সে ক্ষান্ত হয়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে শ্বশুর বাড়িতে লাঠিসোঠা নিয়ে হামলা চালায়। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে রক্তাত্ব জখম করে চাচা শ্বশুর কফেল উদ্দীনকে। এ খবর পেয়ে হান্নানের ছোট ভাই ইউপি সদস্য কামাল হোসেন জোড়পুকুরিয়া বাজার থেকে মোটর সাইকেলযোগে বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটে যাচ্ছিলেন। মাজেদুল ও তার লোকজন হামলা করে বাড়ি ফেরার সময় কামাল হোসেন সামনে পড়েন। তাকে ধারালো অস্ত্র (রামদা) দিয়ে মাথায় কোপানো হয়। এক পর্যায়ে কামাল মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তাকে ফেলে মাজেদুল ও তার লোকজন পালিয়ে যায়। পরিবারের লোকজন ছুটে গিয়ে কামালকে উদ্ধার করে। কামাল ও তার ভাই কফেলকে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক কামালকে মৃত ঘোষণা করেন। আশংকাজনক অবস্থায় কফেল উদ্দীনকে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়।

এদিকে কামালের মৃত্যুর খবরে স্ত্রীসহ পরিবারের সদ্যদের মাথায় যেনো বজ্রপাত পড়ে। হাসপাতাল চত্বরে তাদের বুকফাটা কান্নায় উৎসুক মানুষের ভিড় বেড়ে যায়। স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যদের গলাচেরা কান্নায় এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। মনের অজান্তেই চোখের পানি আসে উৎসুক মানুষের চোখে। উদীয়মান তরতাজা একটি প্রাণ এভাবে ঝরে যাওয়ার কষ্ট শোকের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

এদিকে কামালের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে সন্ধ্যার আগে বাড়িতে পৌঁছায়। সন্ধ্যায় জানাযা শেষে গ্রাম্য কবরস্থানে দাফন করা হয়। জানাযায় নেতৃবৃন্দ, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার বিপুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত হন। তারা শোক প্রকাশের পাশাপশি হত্যাকারী হিংস্র পশু সমদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দাবি করেন।

যা নিয়ে বিরোধ: নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, কামাল হোসেনের ভগ্নিপতি ষোলটাকা গ্রামের আব্দুল্লাহ মিয়ার কাছে মোবাইলে চাঁদা দাবি করে কতিপয় চাঁদাবাজ। চাঁদা না দেয়ায় গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর রাতে পুকুরে বিষ প্রয়োগ করে। এতে ১২ লক্ষাধিক টাকার মাছ নিধন হয়। বিষ প্রয়োগের সাথে জড়িত সন্দিগ্ধ চাঁদাবাজ ষোলটাকা গ্রামের বিছার উদ্দীনের ছেলে রহমতুল্লাহ (৪০) ও জুগিরগোফা গ্রামের বাদশা মিয়ার ছেলে সাবদার আলী ওরফে পল্টুকে (৪২) ২৪ মে গাংনী থানা পুলিশ গ্রেফতার করে। চাঁদা দাবিকৃত মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয় পুলিশ। গ্রেফতার রহমতুল্লাহ হচ্ছে মাজেদুলের ভগ্নিপতি। গ্রেফতারের পেছনে কামাল হোসেনের হাত রয়েছে অভিযোগ তুলে বিরোধ সৃষ্টি করে মাজেদুল।

এদিকে কামাল হোসেনের বসতবাড়ির দক্ষিণে দেড় কাঠা জমি গ্রামের রাইতাল হোসেনের কাছ থেকে রেওয়াজ করা হয়। ওই জমির পেছনে মাজেদুলের জমি রয়েছে। সম্প্রতি মাজেদুল দাবি করেন তিনি ওই দেড় কাঠা জমির মালিক। গায়ের জোরে মালিকানা দাবির বিষয়নি নিয়েও শ্বশুর পরিবারের সাথে তার বিরোধ বাধে। এছাড়াও গেলো বছর অনুষ্ঠিত ষোলটাকা ইউপি নির্বাচনে সদস্য (মেম্বার) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন কামাল হোসেন। কিন্তু অন্য এক প্রার্থীর পক্ষ নেয় মাজেদুল। কামাল হোসেন নির্বাচিত হয়ে মাজেদুলকে কাছে টেনে নেয়। কিন্তু মাজেদুল তাও মেনে নিতে পারেনি। ফলে নির্বাচনের বিষয় নিয়েও বিরোধ ছিলো।

তিনটি বিষয় নিয়ে চাচা শ্বশুর কামালের ওপর আক্রোশ সৃষ্টি হয় মাজেদুলের। সম্প্রতি ওই দেড় কাঠা জমি ছেড়ে দিতে শ্বশুর পক্ষের লোকজনের ওপর চাপ দেয় মাজেদুল। বিষয়টি নিয়ে আপোসে না গিয়ে শুধুই হুমকি দিতে থাকে।

যেভাবে হামলা: নিহত কামালের ভাই মৃত আরোজ আলীর স্ত্রী তহুরা খাতুন বলেন, বুধবার রাতে শ্বশুর আব্দুল হান্নান ও শ্যালক জাহিদুলকে অপদস্থ করে। গতকাল সকালে মাজেদুল শ্বশুর বাড়ির পাশ্ববর্তী নিজ পুকুর দেখতে যায়। রাতের বিষয়টি নিয়ে শ্যালক জাহিদুলের সাথে তার বাকবিতণ্ড বাধে। এক পর্যায়ে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়ে বাড়ির দিকে চলে যায় মাজেদুল। কিছুক্ষণ পরে সাথে কিছু লোক নিয়ে ফিরে আসে। তাদের সবার হাতে ছিলো ধারালো অস্ত্র (রামদা, হেঁসো) ও লাঠিসোটা। শ্বশুর বাড়িতে প্রবেশ করে চাচা শ্বশুর কফেলকে কুপিয়ে জখম করে। হামলা চালিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় কামালকে কুপিয়ে হত্যা করে তারা পালিয়ে যায়। সরজমিনে গতকাল দুপুরে কামালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় স্বজনহারাদের বুকফাটা আহাজারি। স্বামী হারিয়ে অথৈ সাগরে পড়া কামালের স্ত্রী শাপলা। তাকে ঘিরে ২০/২৫ জন নারী। শান্তনা দিচ্ছিলেন সবাই। প্রলাপ করছিলেন শাপলা।

পরিবারে শোকের মাতম: শাপলা খাতুনের প্রলাপে বলছিলেন, ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই সে মানুষের বিপদ-আপদের সাথী ছিলেন। কিন্তু তাকে প্রকাশ্য দিবালোকে অমানুষরা হত্যা করলেও ঠেকানোর জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। আমি এখন কি নিয়ে বাঁচব। সন্ধ্যা হলে ছোট শিশু কন্যা পিতার খোঁজ করে। আজ তাকে আমি কি বলবো? বাড়িতে হামলার খবর কামালকে মোবাইলফোনে জানিয়ে ছিলেন শাপলা খাতুন। পরিবারের সদস্যদের রক্ষায় তিনি দেরি না করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তার দেয়া খবরে কামাল বাড়ি ফিরছিলেন। তাই হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না শাপলা। শাপলা খাতুন বলেন, সারাজীবন ধরেই মাজেদুলের পরিবারের সাথে তাদের বিরোধ। পুকুরে বিষয় প্রয়োগের ঘটনার পর থেকেই কামালের প্রতি চরম আক্রোশের সৃষ্টি হয়। তখন থেকে তাকে হত্যার চেষ্টা করছিলো। পরিকল্পিতভাবে ঠাণ্ডা মাথায় তারা হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেন শাপলা।

কেমন জামাই: নিহত কামালের বড় ভাই আব্দুল হান্নানের মেয়ে রাহেনা খাতুনের সাথে ২৭/২৮ বছর আগে মাজেদুলের বিয়ে হয়। এর আগে থেকেই মাজেদুলের পরিবারের সাথে কামাল পরিবারের সম্পর্ক ভাল ছিলো না। বিভিন্ন কারণে মাজেদুল ও তার পরিবারের সাথে বনিবনা হতো না কামাল পরিবারের। কিন্তু রাহেনা ও মাজেদুলের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক হয়। বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবে নেননি রাহেনার পিতার পরিবার। পরিবারের চরম আপত্তি থাকায় বেছে নেয় ভিন্ন পথ। পরিবার ও বংশের মুখে চুনকালি লাগিয়ে মাজেদুলের হাত ধরে পালিয়ে বিয়ে করে রাহেনা। বিয়ের পর রাহেনার পিতার পরিবার কিছুটা নমনীয় হলেও মাজেদুল শক্ত ভূমিকা পালন করতে থাকে। তাই বিয়ের এতো বছর পেরিয়ে গেলেও রাহেনা পিতার বাড়িতে পা বাড়াইনি। মাজেদুলকে তারা জামাইয়ের সম্মান দিতে থাকেন। কিন্তু মাজেদুল তা মেনে নেয়নি। বিয়ের পর থেকেই শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সাথে কারণে-অকারণে বিরোধ বাধাতে থাকে মাজেদুল ও তার পক্ষের লোকজন। এমনকি কামালের শেষ বিদায় দিতেও যায়নি রাহেনা।

নিহতের পারিবারিক পরিচয়: ষোলটাকা গ্রামের জোয়ার্দ্দারপাড়ার আব্দু সাত্তার জোয়ার্দ্দারের চার ছেলের মধ্যে কামাল ছোট। মেঝ ছেলে আরোজ আলী সাত বছর আগে মৃত্যু বরণ করেন। বড় ছেলে আব্দুল হান্নান, সেঝ ছেলে কফেল উদ্দীন, ছোট ছেলে কামাল হোসেন ও আরোজ আলীর পরিবার নিয়ে তারা একই জায়গায় পৃথক বাড়িতে বসবাস করেন। কামাল হোসেনের একমাত্র বোনের নাম মাজেদা খাতুন। তার বিয়ে হয়েছে শিমুলতলা গ্রামে।

প্রায় ১৫ বছর আগে নিজ গ্রামের মহিবুল ইসলামের মেয়ে শাপলা খাতুনের সাথে কামালের বিয়ে হয়। দাম্পত্য জীবনে তিনি দুই কন্যা সন্তানের জনক। বড় মেয়ে কামিনি স্থানীয় কেজি স্কুলে প্রথম শ্রেণির ছাত্রী। ছোট মেয়ে কলির বয়স তিন বছর। স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে সুখেই কাটছিল কামাল-শাপলার দাম্পত্য জীবন। কামাল হোসেন ভাইদের মধ্যে সবার ছোট হলেও তিনি ছিলেন মূলত বাড়ির কর্তা। নিজ সংসারে পাশাপাশি খোঁজ রাখতেন পরিবারের সকলের। তাই শুধু কামালের স্ত্রী-মেয়ে নয় গোটা পরিবারের মাথায় আকাশ থেকে বজ্রপাত পড়েছে বলে মনে করছে পরিবারটি। ছোট শিশুদের নিয়ে জীবনের বাকি সময় কিভাবে কাটাবেন সে চিন্তায় অথৈ সাগরে পড়েছেন স্ত্রী।

সুরতহাল প্রতিবেদন: নিহত কামাল হোসেনের মরদেহ সুরতহাল প্রতিবেদন করেছেন গাংনী থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, মাথার পেছনের দিকে ছয় ইঞ্চি মতো একটি কাটা দাগ রয়েছে। ধারালো অস্ত্রের এক কোপে মাথার ভেতরে কয়েক ইঞ্চি পর্যন্ত ঢুকে যেতে পারে। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও মাথার গুরুত্বপূর্ণ শিরা-উপশিরা কেটে যাওয়ায় মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন চিকিৎসকরা। তবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলেই নিশ্চিত হওয়া যাবে।

আসামিদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক সাজার জন্য যা যায় করণীয় তা করা হচ্ছে জানিয়ে গাংনী থানার পরিদর্শক (ওসি তদন্ত) কাফরুজ্জামান বলেন, হামলার খবর পাওয়ার সাথে সাথে মাজেদুলসহ তার সঙ্গীয়দের ধরতে পুলিশ অভিযান শুরু করে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একজনকে থানা হেফাজতে নেয়া হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান তিনি।