মেহেরপুরের ছাতিয়ানের পর রাজনগরে মৃত মানুষকে বাঁচাতে আগুনে ঝলসানো হলো লাশ

 

মাজেদুল হক মানিক: মেহেরপুর গাংনী উপজেলার ছাতিয়ান গ্রামের পর এবার সদর উপজেলার রাজনগর গ্রামের মানুষ দেখলো কথিত ওঁঝার বর্বরতা। সর্প দংশনে রাশেদা খাতুন নামের এক নারীর মৃত্যুর পর তাকে বাঁচানোর মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আগুনে ঝলসিয়েছে মদনাডাঙ্গা গ্রামের কবিরাজ সিরাজুল ইসলাম। গতকাল রোববার সকালে গোয়ালঘরে গরুর খাবার দেয়ার সময় রাশেদা খাতুনকে বিষধর সাপে ছোবল দেয়। কবিরাজের এই ভণ্ডামী ইসলামী দৃষ্টিতে যেমনি কুফরি তেমনি এটি ভ্রান্ত ধারণা ও পাগলামি বললেন চিকিৎসকরা।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজনগর গ্রামের রমজান আলীর স্ত্রী রাশেদা খাতুন গতকাল সকালে গোয়ালঘরে গরুর খাবার দিতে গিয়ে বিষধর একটি সাপের ছোবলের শিকার হন। স্থানীয় এক ওঁঝার কাছে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। পরে তাকে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসেন পরিবারের সদস্যরা। কর্তৃব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

স্থানীয় সূত্রে আরও জানা গেছে, রাশেদার লাশ বাড়িতে আনার পর সেখানে হাজির হন সদর উপজেলার মদনাডাঙ্গা গ্রামের কথিত কবিরাজ সাপের ওঁঝা সিরাজুল ইসলাম। রাশেদাকে বাঁচিয়ে দেয়ার আশ্বাসে চিকিৎসার অনুমতি পায়। মৃত মানুষ জীবিত করতে ওঁঝার অলৌকিক কেরামতি দেখতে ঘটনাস্থলে ভিড় করেন হাজারো নারী-পুরুষ। সিরাজুল ইসলাম মন্ত্রতন্ত্র পাঠ শুরু করেন। লাশ উঁচু স্থানে রেখে নিচে আগুন জ্বেলে তাপ দেয়া শুরু হয়। বেশ কিছুক্ষণ আগুনে লাশ ঝলসানোর এ দৃশ্য দেখেন হাজারো মানুষ। কিন্তু কিছুতেই আর মৃত রাশেদা বেঁচে উঠলেন না। এক পর্যায়ে কৌশলে স্থান ত্যাগ করেন কবিরাজ সিরাজুল ইসলাম। উৎসুক মানুষের কয়েকজন সিরাজুল ইসলামের ওই কর্মকাণ্ড ভণ্ডামী ও ধোকা দিয়ে অর্থ কামানোর উদ্দেশে বলে আখ্যায়িত করেন। তবে এ দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করতে গেলে তাতে বাধা দেন কথিত কবিরাজের কয়েকজন ভণ্ড ভক্ত। যারা সিরাজুলকে রাশেদার বাড়িতে নিয়ে আসেন।

এদিকে গত ১৯ জুন ছাতিয়ান গ্রামের কাঠমিস্ত্রি সিরাজুল ইসলাম সর্প দংশনে মৃত্যুর ১০ ঘণ্টা পর তাকে বাঁচানোর মিথ্যা আশ্বাসে আগুনে ঝলসান ফতাইপুর গ্রামের কথিত কবিরাজ আজিল হোসেন। ওই ঘটনার রেষ কাটতে না কাটতেই রাজনগর গ্রামে ঘটলো ওঁঝাদের আরো একটি মধ্যযুগীয় বর্বরতা। দুটি ঘটনায় স্থানীয় আলেমরা তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে এ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। গাংনী বাজার প্রধান জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা রুহুল আমিন গতরাতে মাথাভাঙ্গাকে জানান, ইসলামী দৃষ্টিতে এটি কুফরি। যার গোনাহ ক্ষমার অযোগ্য। লাশের সাথে বেয়াদবি। কেননা মুদ্দার পবিত্রতা বজায় রাখার জন্য সু-স্পষ্ট বিধান রয়েছে। যে কবিরাজ এ কাজটি করেছেন, যে ব্যক্তি এ কাজের অনুমতি দিয়েছেন এবং যারা স্বচক্ষে দেখে এটি বন্ধ করেননি তারাও গুনাহর অংশিদার হবেন।

সর্প দংশনে মৃত্যুর পর ২৪ ঘণ্টা কিংবা ৪৮ ঘণ্টা এমনকি কয়েকদিন ধরে মানুষ জীবিত থাকে এমন ভ্রান্ত ধারণা অনেকেরই মনে বাসা বেঁধে আছে। তবে এটি নিছক পাগলামি ও অজ্ঞতা বলে জানিয়েছেন মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. তাপস কুমার সরকার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মাথাভাঙ্গাকে জানান, এগুলো একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা। বিষধর সাপে দংর্শন করলে দ্রুত হাসপাতালে এনে এন্টিভেনম দিতে পারলে তাকে বাঁচানো সম্ভব। তবে দংশনের স্থানের ওপরে আলগা করে বাঁধন দিতে হবে। এতে বিষ শরীরের ওপরের দিকে সহজে উঠবে না। শক্ত করে বাঁধা যাবে না। এতে নিচের অংশ পচে যেতে পারে। দংশন করা সাপ মেরে অথবা জীবিত ধরে আনতে পারলে ভালো হয়। তানাহলে হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) রোগীর পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে এন্টিভেনম দিয়ে চিকিৎসা দিবেন। দংশন করা সাপ যদি বিষধর না হয় তাহলে তার তেমন চিকিৎসার দরকার নেই। আদিকালের সব ভ্রান্ত ধারণা বাদ দিয়ে সর্প দংশনের রোগীকে হাসপাতালের চিকিৎসার ওপর জোর দিয়ে তিনি আরো বলেন, মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে পর্যাপ্ত এন্টিভেনম রয়েছে।