মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও ঐক্য কামনা

স্টাফ রিপোর্টার: দেশের কল্যাণ, মুসলিম উম্মাহর সুদৃঢ় ঐক্য, দুনিয়া ও আখেরাতের শান্তি কামনা করে আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে গতকাল রোববার শেষ হয়েছে ৫১তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। আখেরি মোনাজাতে আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গুনাহ মাফের পাশাপাশি দুনিয়ার বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করার জন্য দু হাত তুলে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে রহমত প্রার্থনা করা হয়। লাখো ধর্মপ্রাণ মানুষ ‘আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন’ ধ্বনিতে অশ্রুসিক্ত নয়নে সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণে ব্যাকুল হয়ে পড়েন।
আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বি ভারতের হজরত মাওলানা মুহাম্মদ সা’দ। তিনি আরবি ও উর্দু ভাষায় আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন। বেলা ১১টা ৭ মিনিটে শুরু করে ১১টা ৩২ মিনিট পর্যন্ত ২৫ মিনিট স্থায়ী এ মোনাজাতে সারাবিশ্বের সর্বত্র দ্বীন চালু, মুসলিম জাহানের হেফাজত, ইসলামের সকল আয়োজন ও পরিশ্রম কবুল করার জন্য মহান আল্লাহতায়ালার অফুরন্ত রহমত কামনা করা হয়। মোনাজাত চলাকালে ইজতেমা প্রাঙ্গণের দক্ষিণে খিলক্ষেত, উত্তরে বোর্ডবাজার, পূর্বে টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরী ও পশ্চিমে আশুলিয়া পর্যন্ত অন্তত ১৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত বিশাল জনসমুদ্র থেকে আকাশ কাঁপিয়ে ধ্বনি ওঠে ‘ইয়া আল্লাহ! ইয়া আল্লাহ!!’
এ বছর অনুকূল আবহাওয়া থাকায় আখেরি মোনাজাতে দেশ-বিদেশের আনুমানিক ৩০ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ অংশ নিয়েছেন বলে ইজতেমা আয়োজকসহ সংশ্লি¬ষ্ট সূত্রের ধারণা। এছাড়া ইজতেমা ময়দানের পূর্ব পাশে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে স্থাপিত পুলিশের কন্ট্রোল রুমে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আ.ক.ম মোজাম্মেল হক, স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, স্বরাষ্ট্র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান, জেলা প্রশাসক এসএম আলম, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ প্রমুখ।
আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে রোববার ভোর না হতেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে লাখ লাখ মুসল্লি পায়ে হেঁটে ইজতেমাস্থলে পৌঁছেন। সকাল ৯টার আগেই ইজতেমা মাঠ ও এর আশপাশ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। মুসল্লিরা মাঠের আশপাশের রাস্তা, অলি-গলিতে অবস্থান নেন। ইজতেমাস্থলে পৌঁছুতে না পেরে কয়েক লাখ মানুষ আশুলিয়া, কামারপাড়া সড়ক, ঢাকা-কালীগঞ্জ সড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নেন। অনেকেই পুরনো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিনশিট বিছিয়ে বসে পড়েন। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী বাসা-বাড়ি, কল-কারখানা, অফিস, দোকানের ছাদে, যানবাহনের ছাদে ও তুরাগ নদীতে নৌকায় মুসল্লিরা অবস্থান নেন। যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই দেখা যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পরা মানুষের কাফেলা। সবার অপেক্ষা, কখন শুরু হবে আখেরি মোনাজাত। মোনাজাতের জন্য গতকাল আশপাশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতে ছিলো ছুটি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা না করলেও কর্মকর্তাদের মোনাজাতে অংশ নিতে বাধা ছিলো না। নানা বয়স ও পেশার মানুষ এবং নারীরাও ভিড় ঠেলে মোনাজাতে অংশ নেন।
আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইলেন বান্দারা: ২৫ মিনিটব্যাপী মোনাজাতের শুরুতে প্রায় ১০ মিনিট আরবিতে দোয়া-দরুদ পাঠ করা হয়। এরপর সেই দোয়া উল্লেখ করে আল্লাহতায়ালার দরবারে মানুষের হেদায়েত কামনা করা হয়। মোনাজাতে বলা হয়, হে আল্লাহ! আমরা নিজেদের প্রতি অনেক অবিচার-অত্যাচার করেছি। হাজারো হুকুম অমান্য করেছি। তুমি আমাদের ক্ষমা করে দাও। তুমি আমাদের ওপর রহমতের চাদর বিছিয়ে দাও। হে আল্লাহ! তোমার প্রিয় বান্দা হিসেবে কবুল করে নাও। সমস্ত বিশ্ববাসীকে হেদায়েত করো। যারা জীবিত আছে তাদের ক্ষমা করো। যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদেরও ক্ষমা করো।
টেলিভিশন-মুঠোফোন ও ওয়্যারলেস সেটে মোনাজাত: ইজতেমা মাঠে না এসেও মোনাজাতের সময় হাত তুলেছেন অসংখ্য মানুষ। গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা মসজিদ মাঠ এলাকায় ওয়্যারলেস সেটে, মুঠোফোনের মাধ্যমেও মোনাজাত প্রচার করা হয়। এসব স্থানে নারীদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিলো। আবার টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সরাসরি সম্প্রচার করার কারণে অনেকে বাসায়, দোকানে বাজারে ও মাইক লাগিয়ে মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন।
বিদেশি মেহমান ১০ হাজার: এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার ৯৯টি দেশের তাবলিগ জামাতের প্রায় ১০ হাজার মেহমান এবারে প্রথম পর্বের ইজতেমায় অংশ নেন। এদের মধ্যে ভারত থেকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মেহমান এসেছেন বলে আয়োজক সূত্রে জানা গেছে।
প্রথম পর্বে ৩ হাজার জামাত: বিভিন্ন দেশে তাবলিগের কাজে বের হতে এবার ইজতেমা স্থলে প্রথম পর্বে তিন হাজার জামাত তৈরি হয়েছে বলে জানান ইজতেমা আয়োজক কমিটির মুরুব্বি প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন। এসব জামাতে কেউ কেউ তিন চিল্লা এমনকি আজীবন চিল্লার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। আগামী কিছু দিনের মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে।
টঙ্গী হাসপাতালে চিকিত্সা: টঙ্গী সরকারি হাসপাতাল ও সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে ৫টি ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পে গতকাল রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ইজতেমায় আগত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ৬১৩৭ জন মুসল্লি চিকিত্সা নিয়েছেন। এদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট ও হূদরোগে আক্রান্ত ১৬ জনকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। ৫৭ জনকে টঙ্গী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. আলী হায়দার খান। এছাড়া হামদর্দসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে ফ্রি চিকিত্সাকেন্দ্রে কয়েক হাজার মুসল্লি চিকিত্সা নিয়েছেন।
ইজতেমায় বিদেশিসহ ৮ মুসল্লির মৃত্যু: ইজতেমার মুরুব্বি ইঞ্জিনিয়ার গিয়াস উদ্দিন জানান, রোববার ভোর পৌনে ৫টার দিকে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার লক্ষ্মীপুর এলাকার মৃত কাছিম উদ্দিনের ছেলে দলিলুর রহমান (৭৫) বার্ধক্যজনিত কারণে এবং একই জেলার ভেন্নাবাড়ী হরিনারায়ণপুর এলাকার মীর হোসেন আকন্দের ছেলে জয়নাল আবেদীন (৬০) রাত ১টার দিকে শ্বাসকষ্টজনিত কারণে মারা যান। এর আগে গত শনিবার সকালে ঢাকা থেকে ইজতেমায় আসার সময় পুর্নম সোপান ওরফে সোফা হাজি (৬৭) নামে এক ইন্দোনেশীয় নাগরিক মারা যান। ইজতেমা ময়দানে এশার নামাজের পর জানাজাশেষে ইজতেমা ময়দানের কবরস্থানেই তাকে দাফন করা হয়। শনিবার ভোর ৫টার দিকে ইজতেমা ময়দানে হঠাত অসুস্থ হয়ে মারা যান সিলেটের আলাউদ্দিন (৭০)। এরপর রাত দেড়টার দিকে হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আবুল বাশার (৬০)। বৃহস্পতিবার রাতে সিলেটের গোপালগঞ্জ উপজেলার রনকালি এলাকার জয়নাল আবেদীন (৫৫), কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার চকলাপাড় গ্রামের নূরুল ইসলাম (৭২) ও নাটোরের সিংড়া উপজেলার বটিয়া গ্রামের ফরিদ উদ্দিন (৬৫) হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
বাড়ি ফেরায় দুর্ভোগ: মোনাজাত শেষে লাখো মুসল্লি তাদের নিজস্ব গন্তব্যে যেতে যানবাহন সঙ্কটে পড়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হন। মোনাজাতশেষে লাখ লাখ মুসল্লি ইজতেমা ময়দান থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে স্রোতের মতো একসাথে ফিরতে শুরু করলে এক পর্যায়ে ময়দানের চারদিকে ৬/৭ কিলোমিটার বিস্তৃর্ণ এলাকায় জনস্রোত সৃষ্টি হয়। এসব এলাকার সকল রাস্তা একপর্যায়ে মুসল্লিদের বাড়ি ফেরার কাফেলায় পরিণত হয়। অনেকেই পায়ে হেঁটে গন্তব্যে রওনা দেন।
১৫ জানুয়ারি থেকে ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব: আগামী ১৫ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমার তিনদিনব্যাপী দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে। দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় মুসল্লিদের অংশ নেয়ার জন্য জেলাওয়ারি পুরো প্যান্ডেলকে ২৯টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। এতে ঢাকাসহ ১৬টি জেলার মুসল্লিরা অংশ নেবেন। খিত্তা অনুযায়ী এসব জেলাগুলো হচ্ছে, ১নং থেকে ৭নং খিত্তায় ঢাকা জেলার বাকি এলাকা, ৮নং খিত্তায় ঝিনাইদহ, ৯ ও ১১নং খিত্তায় জামালপুর, ১০নং খিত্তায় ফরিদপুর, ১২ ও ১৩নং খিত্তায় নেত্রকোনা, ১৪ ও ১৫নং খিত্তায় নরসিংদী, ১৬ ও ১৮নং খিত্তায় কুমিল্লা, ১৭নং খিত্তায় কুড়িগ্রাম, ১৯ ও ২০নং খিত্তায় রাজশাহী, ২১নং খিত্তায় ফেনী, ২২নং খিত্তায় ঠাকুরগাঁও, ২৩নং খিত্তায় সুনামগঞ্জ, ২৪ ও ২৫নং খিত্তায় বগুড়া, ২৬ ও ২৭নং খিত্তায় খুলনা, ২৮নং খিত্তায় চুয়াডাঙ্গা এবং ২৯নং খিত্তায় পিরোজপুর জেলার মুসল্লিরা অবস্থান নেবেন।
আখেরি মোনাজাতে শরিক হলেন খালেদা জিয়া: রাজধানীর গুলশানে ভাড়া করা বাসভবন ‘ফিরোজা’ থেকে আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গতকাল বেলা ১১টার দিকে টঙ্গীর তুরাগ তীরের ইজতেমা ময়দানে আখেরি মোনাজাত শুরু হওয়ার সাথে সাথে বাসা থেকে খালেদা জিয়া এতে শরিক হন। বিগত বছরগুলোতে টঙ্গীর ঐতিহাসিক বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে গিয়ে মোনাজাতে অংশ নিতেন খালেদা জিয়া। কিন্তু গত বছর রাজনৈতিক পরিবেশ অনুকূলে না থাকায় আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে তিনি ইজতেমা ময়দানে যাননি। ওই সময় তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে বসেই মোনাজাতে অংশ নেন খালেদা জিয়া। এবার সে ধরনের পরিস্থিতি না থাকায় বাসায় বসেই দোয়ায় অংশ নিয়েছেন।