মুজিবনগর তারানগরে আর্সেনিকের কালো থাবা বিস্তার!

 

 

সুপেয় পানির জন্য হাহাকার : যন্ত্র থাকলেও কাজে আসছে না

মহাসিন আলী/শেখ শফি: আর্সেনিকের ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়েছে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার তারানগর গ্রামসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে। সুপেয় পানির অভাব এলাকাবাসীকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। তারানগর গ্রামের ১৬৫টি টিউবওয়েলের মধ্যে ১৬০টিতে অধিক মাত্রার আর্সেনিক শনাক্ত হয়েছে। তারানগর গ্রামের আড়াই হাজার মানুষের মধ্যে ৫০০ মানুষ আর্সেনিকে আক্রান্ত এবং আর্সেনিক ধরা পড়ার পরে গত ১০ বছরে গ্রামের প্রায় ২০০মানুষ আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

মেহেরপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে মুজিবনগর উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী গ্রাম তারানগর। এ গ্রামের লোকসংখ্যা ২ হাজার ২৫৮ জন। গ্রামের ভূ-গর্ভস্থ পানিতে মাত্রারিক্ত আর্সেনিক সনাক্ত হয়েছে। আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে গত ১০ বছরের মারা গেছেন ওই গ্রামের কিতাব আলী মাস্টার (৫২), তার স্ত্রী সাফাতন বিবি (৪৬), কলিমুদ্দিন (৪০), তার স্ত্রী মহুকা খাতুন (৩২), মা আশেরা খাতুন (৫৫) ও বোন আকলিকা খাতুন (২৪), কিতাব মল্লিক (৬০), তার ছেলে ফিতাজুল (২০), ফ্যাতা (৫২) তার স্ত্রী মহিলা খাতুন (৪৩), নামাজ আলী (৪২), তার ভাই কাশেম আলী (৩৮) ও হাশেম আলী (৩৫)। এছাড়া ওই গ্রামের ওয়াহেদ আলী (৫৫), লাল ভানু (৩২), ইসমাইল হোসেন (৫০), আব্দার আলী (৪০), মুজাম (৪৫), হারুন (২২) ও তার পিতা আলী হোসেন (৪৫), আজমত (৪২), হাবিবুল রহমান (৩৭), নূর ইসলামসহ (৫৫) ১৫০থেকে ২০০জন মারা গেছেন বলে জানান জয়পুর-তারানগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শহিদুল ইসলাম। তিনি আরো বলেন, আক্রান্ত রোগির মধ্যে ওই গ্রামের একই পরিবারের আপন তিনভাই শহিদুল ইসলাম (৪০), বরকত উল্লাহ (৩৬) ও শওকত আলী (৩২), আরেক পরিবারের আপন তিনভাই ইসরাফিল (৪৫), হাশেম আলী (৩৮) ও হোসেন আলী (৩২)। এছাড়া ওই গ্রামের মোশারেফ হোসেন (৩৭), লুৎফর রহমান (৩৮), নেছা খাতুনসহ (৪৫) প্রায় ৫০০ জনলোক আক্রান্ত রয়েছেন।

খাবার জন্য সুপেয় পানির পাশাপাশি আর্সেনিকে আক্রান্ত দরিদ্র মানুষেরা চিকিৎসার জন্য অর্থ জোগাড় করতে পারছেন না। ফলে বিনা চিকিৎসায় তাদের মরতে হচ্ছে। ওই গ্রামের আর্সেনিকে আক্রান্ত ইস্রাফিল জানালেন, মাঝেমাঝে এনজিও’র লোকজন এসে বড়ি ওযুধ দেয়। তা চিকিৎসার ক্ষেত্রে অপ্রতুল। ভালো চিকিৎসার জন্য টাকা পাবো কোথায়?তাই বিনা চিকিৎসায় প্রাণ দিতে হবে। এটা মেনে নেয়া ছাড়া আমাদের আর বিকল্প কী আছে?

এদিকে গ্রামের অধিকাংশ টিউবওয়েলে মাত্রারিক্ত আর্সেনিক রয়েছে বলে গ্রামবাসী টিউওয়েলের পানি পান করেন না। গ্রামের প্রায় ২০০ঘর লোক ওই গ্রামের মরহুম আজিজুল হক মাস্টারের বাড়ির ১০০বছর আগে খনন করা ইদারার আর্সেনিক মুক্ত পানি পান করে থাকেন। সকালে ও বিকেলে গ্রামের বধূরা লাইন দিয়ে টিউবওয়েলের মাধ্যমে ওই ইদারার পানি তুলে নিয়ে যান।

ওই গ্রামের বাসিন্দা গোপালনগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল মালেক বলেন, সুপেয় পানির জন্য ৫-৬ বছর আগে জন স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগে তারানগর গ্রামে ১৫-২০টি পাতকূয়া বসানো হয়। ওই গুলোর অধিকাংশ ইতিমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। ২-৩টি ভালো আছে। তবে একেকটি থেকে মাত্র ২-৩টি পরিবারের পানি নেয়া চলে। আর্সেনিমুক্ত পানির জন্য গ্রামের মোড়ে সেভ দি চিলড্রেনের উদ্যোগে সিডকো প্লান স্থাপন করা হয়। কিন্তু বিদ্যুত সংযোগের অভাবে এখনো পর্যন্ত তা কোনো কাজে আসছে না।

তারানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৩০০জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের জন্য বিদ্যালয়ে টিউবওয়েল ও পাতকূয়া থাকলেও তা আর্সেনিকমুক্ত নয়। প্রধান শিক্ষক প্রশান্ত মণ্ডল বললেন, বিদ্যালয়ের তিন শতাধিক শিক্ষার্থী পানির অভাবে কষ্টের মধ্যে রয়েছে।

জয়পুর-তারানগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বরকত আলীসহ ওই গ্রামের অবস্থাশালী কয়েক ব্যক্তি নিরাপদ পানি পেতে বাড়ির ছাদ থেকে পলিথিন পাইপের মাধ্যমে বড় বড় প্লাস্টিকের ট্যাংকে অথবা মাটির নীচে বিশেষভাবে তৈরি কূয়ায় পানি ধরে রাখছেন। পরে বিভিন্ন উপায়ে পরিশোধন করে ওই পানি সারা বছর পান করার চেষ্টা করছেন। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র হওয়ায় ওইভাবে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করা সকলের পক্ষে সম্ভব হয়না।

গ্রামের সুপেয় পানির উৎসগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্টদের কাছে বারবার ধর্ণা দিয়ে কোনো ফল পাওয়া যায়নি বলে জানান ওই গ্রামের দবির উদ্দিন। তার নাতি মেহেরপুর জিনিয়াস ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী তনিমা জানায়, মেহেরপুর শহর থেকে নানা বাড়ি তারানগর গেলে সাথে সুপেয় পানি বোতল অথবা কন্টিনার ভরে নিয়ে যেতে হয়।

মুজিবনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হাসান আলী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দেশের অস্থিতিশীল অবস্থার কারণে সম্প্রতি আর্সেনিক আক্রান্তদের কোনো তালিকা করা হয়নি। সত্বর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি পরামর্শ দেন ডোবা-পুকুরের পানি আপাতত ফুটিয়ে পান করা যেতে পারে। অন্যথায় রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মুজিবনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে আর্সেনিক কবলিত তারানগর গ্রামের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় এক এনজিও’র হিসাব মতে তারানগর গ্রামের পানিতে ৩০০ পিপিবি থেকে ৫০০ পিপিবি মাত্রার আর্সেনিক আছে।

মেহেরপুর জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, মেহেরপুর জেলার ভোলাডাঙ্গা, আলমপুর আমঝুপি ও তারানগরসহ কয়েকটি এলাকার পানিতে আর্সেনিক সনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে তারানগরের অবস্থা ভয়াবয়। ওই গ্রামের ১৬৫টি টিউবওয়েলের প্রায় সবগুলোতে আর্সেনিকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ওই গ্রামের মাটির ভূ-গর্ভে পাথর থাকায় ৩০০থেকে ৩৫০ফুটের বেশি পাইপ বসানো সম্ভব নয়। যে কারনে আর্সেনিকমুক্ত পানি পাওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। তবে সিডকো’র মতো চলমান আর্সেনিক রিমোভাল প্লান কিংবা মিনি ট্রিটমেন্ট প্লান স্থাপন করা গেলে গ্রামবাসীকে আর্সেনিকমুক্ত পানি পান করান সম্ভব হবে।