মুখ্য আলোচ্য এখন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলা

 

স্টাফ রিপোর্টার: নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ছাপিয়ে কয়েকদিন ধরে রাজনীতিতে মুখ্য আলোচ্য হয়ে উঠেছে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলার গতিপ্রকৃতি। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিচারাধীন জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ মামলার পরিণতি নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়েছে বিএনপি শিবিরে। মামলা দুটির বিচারকাজ চূড়ান্ত ধাপে আসায় এবং আদালত কর্তৃক ঘনঘন তারিখ পড়ায় দুশ্চিন্তার মাত্রা বেড়েছে কয়েকগুণ। মামলা আদালতে বিচারাধীন হলেও বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, মিথ্যা মামলায় জোর করে সাজা দিয়ে সরকার খালেদা জিয়াকে আগামী নির্বাচনের বাইরে রাখার ষড়যন্ত্র করছে। এমনকি খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে জেলে পাঠানো হলে দেশে নির্বাচন হবে না বলেও দলটি হুঁশিয়ারি দিয়েছে। জবাবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন- এটা আদালতের বিষয়, তবে খালেদা জিয়ার জন্য নির্বাচন থেমে থাকবে না।

খালেদা জিয়ার মামলার পরিণতি নিয়ে বাহাস শুধু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এই দুটি দল ছাড়াও অন্যান্য দলসহ গোটা রাজনৈতিক অঙ্গনেই এ নিয়ে নানামুখী আলোচনা, বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হবে কী হবে না, সাজা হলে কী হবে, সাজা না হলে কী হবে, নিম্ন আদালতে সাজা হলেই খালেদা জিয়া নির্বাচনে অযোগ্য হবেন কী হবেন না, সাজা হলে উচ্চ আদালতে আপিল করার পর কী হবে, নিম্ন আদালতের রায় উচ্চ আদালত স্থগিত করলে বা না করলে কী হবে, স্থগিত না হয়ে উচ্চ আদালতে শুধু বিচারাধীন থাকলে কী হবে-এ রকম খুঁটিনাটি নানা কথা ও হিসাব-নিকাশ চলছে রাজনীতির অলিগলিতে।

খালেদা জিয়ার মামলার বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল শুক্রবার সাথে আলাপকালে বলেন, আমরা বারবারই বলে আসছি-মামলাগুলো মিথ্যা। এসব মামলার কোনো মেরিট নেই। তাছাড়া এটা ব্যক্তিগত সম্পদ বিষয়ক মামলা, এখানে খালেদা জিয়া কোনো অর্থ আত্মসাত্ করেননি। এরপরেও আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে-সরকার জোর করে তাকে সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য করতে চাচ্ছে। মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠানো হলে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না- বিএনপি মহাসচিবের এ রকম হুঁশিয়ারির জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার কিংবা জেলে পাঠানোর কোনো ভাবনা সরকারের নেই। আদালতে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে সে কারাগারে যাবে কি-না, সে মাফ পাবে কি-না সেটা আদালত বলতে পারবে। সময় ও স্রোত যেমন কারো জন্য অপেক্ষা করে না, তেমনি বাংলাদেশের সংবিধান ও নির্বাচন কারো জন্য অপেক্ষা করবে না।

জানতে চাইলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক গতকাল বলেন, নিম্ন আদালতে সাজা হলেই কেউ নির্বাচন করতে পারবেন কি-না, বিষয়টি আসলে আমাদের আইনে স্পষ্ট নয়। নিম্ন আদালতে খালেদা জিয়ার সাজা হলে তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করবেন, এটা স্বাভাবিক। উচ্চ আদালত যদি নিম্ন আদালতের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ না দেয় এবং আপিল বিচারাধীন থাকলে আইনের স্বাভাবিক হিসাব বলে-কারাগারে থেকেই তিনি নির্বাচন করতে পারবেন। আর উচ্চ আদালত যদি তার আপিল খারিজ করেন তাহলে অন্য কথা। তাছাড়া উচ্চ আদালতের ইদানীং কিছু রায়ে বিষয়গুলো নিয়ে অস্পষ্টতা দেখা দিয়েছে। যেমন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার সাজা হয়েছিল, হাইকোর্ট তার আপিল খারিজ করে দেয়, এরপর আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ খারিজ করে নতুন করে শুনানির নির্দেশ দেয়। এর অর্থ হচ্ছে মামলাটি এখনো হাইকোর্টে বিচারাধীন। কিন্তু মায়ার মন্ত্রিত্ব কিংবা সংসদ সদস্য পদ তো যায়নি। আপিল করা অবস্থায় তিনি সংসদ সদস্য পদে বহাল আছেন। কাজেই এখানে মন্ত্রী মায়ার বিষয়টি একটি উদাহরণ হয়ে থাকছে। এই উদাহরণ ধরে এটা বলা যায়, উচ্চ আদালতে আপিল থাকলে কেউ নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার কথা নয়।

শাহদীন মালিক বলেন, ‘নবম সংসদের সদস্য থাকা এবং যিনি বর্তমান সংসদেরও সদস্য ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মামলার রায় ও এর ঘটনাপ্রবাহও আমাদের সামনে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের আদালত অবমাননার রায়ও দৃষ্টান্ত, এই দুই মন্ত্রী দণ্ডিত হয়ে জরিমানা দিয়েছেন, বাস্তবতা হলো তারা সংসদ সদস্য আছেন, মন্ত্রী হিসেবেও বহাল রয়েছেন। কক্সবাজার-৪ আসনের এমপি (আওয়ামী লীগের) আবদুর রহমান বদির তিন বছর সাজা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে আপিল চলমান, বাস্তবতা হচ্ছে তিনিও এমপি পদে বহাল আছেন। কাজেই নিম্ন আদালতে সাজা হলেই কোনো ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারবেন না—বিষয়টি চূড়ান্ত নয় বলেই ধরে নেওয়া যায়। বিশিষ্ট এই সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্যতা-অযোগ্যতা সম্পর্কে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদেও হইবার, থাকিবার ইত্যাদি কথা বলা আছে। এখন কথা হলো সরকারি দলের এমপি-মন্ত্রীদের স্বপদে বহাল থাকার যেসব উদাহরণ সবার সামনে আছে, স্বাভাবিক হিসাবে সেই সুযোগ খালেদা জিয়ারও থাকার কথা। কিন্তু এরপরও কথা থেকে যায়, কারণ এখানে তো কোনো কিছু আইনে চলছে না।

সংবিধানের ৬৬ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি (ক) কোন উপযুক্ত আদালত তাকে অপ্রকৃতিস্থ বলিয়া ঘোষণা করেন; (খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হইবার পর দায় হইতে অব্যাহতি লাভ না করিয়া থাকেন; (গ) তিনি কোন বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোন বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন; (ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বত্সরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বত্সরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।

প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ৮ আগস্ট খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলাটি দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ মামলায় ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক। আর এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলা করে দুদক। ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় এই মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলায় ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট দুদক আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়।