মালয়েশিয়ার জঙ্গলে ৩০ গণকবরের সন্ধান

থাই-মালয় জঙ্গলে অসংখ্য গণকবর, জিরো পয়েন্টে আছে ৫ শতাধিক অভিবাসী

 

স্টাফ রিপোর্টার: থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী জঙ্গলে একের পর এক গণকবরের সন্ধান মিলছে। মিয়ানমার ও বাংলাদেশ থেকে মানবপাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের নির্যাতন ও পরে মুক্তিপণ না পেয়ে ওই জঙ্গলেই গণকবর দেয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন, বাসিন্দা ও জঙ্গলের রাবার শ্রমিকরা জানিয়েছেন, দুদেশের মধ্যবর্তী জঙ্গলের সংরক্ষিত অংশে অসংখ্য গণকবর রয়েছে। ইতোমধ্যে যতো গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি কবর ওই জঙ্গলে রয়েছে। দুদেশের সীমান্তবর্তী থাইল্যান্ডের সংখলা প্রদেশের পাটাংবাচা ও মালয়েশিয়ার পেরলিস প্রদেশের ওয়াং কেলিয়ান এলাকায় এই গহীন জঙ্গলটি অবস্থিত। আর এ জঙ্গলকে ঘিরে এতোদিন ধরে চলেছে নারকীয় হত্যাকাণ্ড। এ জঙ্গলের দুদেশের মধ্যবর্তী জিরো পয়েন্টে বর্তমানে ৫ শতাধিক মানবপাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তি অবস্থান করছে বলে রোহিঙ্গারা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন।

এদিকে, মালয়েশিয়া সরকার কর্তৃক সমপ্রতি সেখানে পাচারকারীদের কোনো ক্যাম্প না থাকার কথা দাবি করা হলেও সেখানেও গণকবর উদ্ধার করা হয়েছে। থাইল্যান্ডের পর মালয়েশিয়ার সীমান্ত পেরলিস প্রদেশের ওয়াং কেলিয়ান জঙ্গলে ৩০টি গণকবরের সন্ধান মিলেছে। লাশগুলো সমুদ্র পথে পাচার হওয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও কিছু বাংলাদেশির। এর আগে গত ১ মে থাইল্যান্ডের সংখলা প্রদেশের পাটাংবাচা জঙ্গলে ৩৮টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেখান থেকে প্রায় ৬৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার পর মানবপাচার ইস্যু নিয়ে সারাবিশ্বে হইচই পড়ে যায়। মানবপাচারকারীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে থাই প্রশাসন। এ ঘটনায় জেলার মেয়রকে গ্রেফতারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অর্ধশতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বিভিন্ন স্থান থেকে অভিবাসন প্রত্যাশীদের নৌকায় করে প্রথমে আনা হয় থাইল্যান্ডের সংখলা জঙ্গলে। সেখানে পাচারকারীদের বিভিন্ন ক্যাম্পে রাখা হয়। পরে সময় সুযোগ মতো তাদের মালয়েশিয়া পাঠানো হয়। থাই সীমান্ত সংলগ্ন দক্ষিণাঞ্চল ও মালয়েশিয়ার উত্তরাঞ্চলকে মানবপাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে পাচারকারীরা। গত দুবছরে বিশাল এ জঙ্গল দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে পাচার করা হয়েছে। তবে গত কয়েক মাস থাই ও মালয় সরকার মানবপাচার ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নিলে বিপাকে পড়ে মানবপাচার সিন্ডিকেট। ফলে তাদেরকে জঙ্গল থেকে মালয়েশিয়ায় পাচার করাও সম্ভব হচ্ছিল না। এমতাবস্থায় মানবপাচারকারীরা নিরীহ মানুষদের জঙ্গলেই মেরে গণকবর দেয়।

মালয়েশিয়ায় গণকবরের সন্ধান: মালয়েশিয়ায় পাওয়া দেশটির পারলিস প্রদেশের ওয়াং কেলিয়ান নামক জঙ্গলে দুটি গণকবরে প্রায় ১শ রোহিঙ্গার লাশ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মালয়েশিয়ার একটি সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে, থাইল্যান্ডের সীমান্ত সংলগ্ন মালয়েশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় পেরলিস প্রদেশের দুটি স্থানে ৩০টি গণকবর আবিষ্কার করেছে দেশটির পুলিশ। ওই গণকবরগুলোতে শ শ মানুষের দেহাবশেষ আছে। গত শুক্রবার দেশটির পাটাংবাচারের জঙ্গলের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় একটি গণকবরে প্রায় ১শ জন রোহিঙ্গা অভিবাসন-প্রত্যাশীর দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। পত্রিকাটি লিখেছে, কুয়ালালামপুর থেকে পুলিশের কমান্ডো ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা উদ্ধারস্থলে পৌঁছেছেন। ডিএনএ (জিন শনাক্তকরণ) পরীক্ষার পর মৃতদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা যাবে। তবে অভিযান শেষ না হওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি মালয়েশীয় সরকার। স্থানীয় এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, যেখানে গণকবর পাওয়া গেছে, সেটি একটি সংরক্ষিত এলাকা। সেখানে সাধারণ জনগণের প্রবেশাধিকার নেই। পাহাড়ি ওই এলাকাটি এখন ঘিরে রাখা হয়েছে। মালয়েশিয়া পুলিশের মহাপরিদর্শক খালিদ আবু বকর আজ সোমবার এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে পারেন।

জিরো পয়েন্টে ৫ শতাধিক অবৈধ অভিবাসী: থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী জঙ্গলের জিরো পয়েন্টে ৫ শতাধিক অবৈধ অভিবাসী অবস্থান করছেন। এদের অধিকাংশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা। সবাই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। মানবপাচারে জড়িত বাংলাভাষি ৬ রোহিঙ্গা বলেন, জিরো পয়েন্টে এখনো ৫ শতাধিক মানুষ রয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের সাথে কিছু বাংলাদেশি নাগরিকও আছে। এদের সংখ্যা আরো বেশি ছিলো। তবে সুযোগ বুঝে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ জনকে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়েছে। এরা ১ মের আগেই সমুদ্রপথে এসে এ জঙ্গলে অবস্থান করে। গণকবরের উদ্ধারের পর থেকে মানবপাচার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

অপর ৫ মানবপাচারকারী জানান, দুভাবে মানুষকে পাচার করা হতো। তারা বিমানপথে ও সমুদ্রপথে থাইল্যান্ডে আসতো। সমুদ্রপথে মানবপাচার নিয়ন্ত্রণ করে রোহিঙ্গা দালালরা। আর বিমানে মানবপাচার নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশি দালালরা। বিমানে পাচার হওয়া ব্যক্তিদের জঙ্গলে রাখা হতো না। কিন্তু যারা সমুদ্রপথে আসতো তাদের জঙ্গলে রাখা হতো। এদেরকে রোহিঙ্গা দালালরাই নিপীড়ন-নির্যাতন ও মহিলাদের পাশবিক নির্যাতন চালাতো। এ রোহিঙ্গা দালালরাই জঙ্গলে মানবপাচারের শিকার হওয়াদের গণকবর দিয়েছে।

উল্লেখ্য, মিয়ানমারে সরকারের নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গারা ২০১৩ সাল থেকে সমুদ্রপথে ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবেশী মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশ থেকেও কাঠের নৌকা বা মাছ ধরা ট্রলারে করে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টার ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। গত ১মে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবর পাওয়ার পর মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড উপকূলে সাগরে ভাসমান অবস্থায় পাচারকারীদের কয়েকটি নৌকা থেকে তিন হাজারের বেশি মানুষকে উদ্ধার করা হয়। সার্বিক পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের উদ্বেগের মুখে বিপদগ্রস্ত মানুষদের সাগর থেকে উদ্ধার করে সাময়িক আশ্রয় দিতে সম্মত হয়েছে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া।