মানবপাচার : খাবার নিয়ে মারামারিতে একশ ক্ষুধার্তের মৃত্যু

স্টাফ রিপোর্টার: দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে মানব পাচার নিয়ে সঙ্কট বাড়ছেই। সাগরে যাত্রাপথে অভিবাসীদের ওপর নির্যাতন, মৃত্যুসহ তাদের মানবেতর জীবন ও তীব্র মানবিক বিপর্যয়ের তথ্য প্রতিদিনই প্রকাশ পাচ্ছে। এমনকি অনাহারী মানুষগুলো বেঁচে থাকার জন্য একে-অপরের সাথে সহিংসতায়ও জড়িয়ে পড়ছে। গত দু মাসে ভাসমান নৌকায় এমন সংঘাতে কমপক্ষে ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে।

এদিকে, মিয়ানমারের সরকার জানিয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাগরে অভিবাসীদের নৌকায় ঝুঁকিতে থাকা অভিবাসীদের বিষয়ে তাদের কোনো দায়িত্ব নেই। এমনকি এ বিষয়ে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য ১৫ দেশের জরুরি বৈঠকে তারা অংশ নাও নিতে পারে। অন্যদিকে, থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ সম্মেলনের বিষয়টি অবহিত করেছেন। সরকার মানব পাচার বন্ধে দুই দেশের উদ্যোগে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে জানানো হয়েছে। আর মানব পাচার রোধে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারে একমত পোষণ করেছেন মালয়েশিয়া সফররত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী।

গত এক সপ্তাহে প্রায় তিন হাজার বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অভিবাসী উদ্ধার হয়েছেন। কয়েক হাজার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি এখনো নৌকায় আন্দামান সাগর ও মালাক্কা প্রাণালীতে ভাসছেন। তবে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের আহ্বান উপেক্ষা করে তাদেরকে তীরে ভিড়তে না দেয়ার নীতিতে অটল রয়েছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী। খাবার বা পানি ছাড়াই নৌকায় থাকা মানুষগুলোর অবস্থা এখন শোচনীয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, এই অভিবাসীরা চরম মানবিক সঙ্কটে রয়েছে এবং তাদের জীবন নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। খাবার ও পানির অভাবে তারা মারা যেতে বসেছে। তবে কোনো দেশই তাদের রক্ষায় ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

গতকাল রোববার এবিসি অনলাইন-রেডিও অস্ট্রেলিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে আশ্রয় নেয়া অভিবাসী ও শরণার্থীরা জানিয়েছে- সাগরে যাত্রাকালে প্রায় দুশ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে তাদের সঙ্গে যাত্রাপথে ছিলো এমন ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে- যাদের মধ্যে সাতজনই শিশু। নৌকা থেকে সাগরের পানিতে পড়ে ডুবে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী তাদের নৌকাকে সাগরে ফেরত পাঠানোর আগেই এ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে তারা জানান।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বৃহস্পতিবার ৬৭৭ জনকে ইন্দোনেশিয়ার জেলেরা উদ্ধার করে। গত কয়েক মাস ধরে সাগরে ভেসে ছিলো এসব অবৈধ অভিবাসী। নৌকায় খাবার ও পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিরা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এতে অন্তত ১০০ জন মারা যায়। ২১ বছর বয়সী রোহিঙ্গা ব্যক্তি মুহাম্মদ রফিক বলেন, নৌকায় বাংলাদেশিরা বেশি আগ্রাসী ছিলো। তারা ছুরি ও হাতুড়ি দিয়ে আমাদের লোককে হত্যা করেছে। তবে বাংলাদেশি মোহাম্মদ আবদুর রহিমের দাবি- এ সংঘাত রোহিঙ্গারা শুরু করে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা আমাদের কোনো খাবার, পানি দিতো না। বরং প্রতিদিনই তারা আমাদের উপর অত্যাচার করেছে।

গতকাল ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যাত্রাপথে কাঠের তক্তা দিয়ে একটি পরিবারের সদস্যদের পিটিয়ে মারা হয়েছে। ওই পরিবারে স্বামী-স্ত্রী ও তাদের একটি ছেলে ছিল। মোহাম্মদ আমিন নামে এক ব্যক্তি বলেন, তাদের লাশ পানিতে ফেলে দেয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে, পাচারকারীরা নৌকাগুলো ফেলে যাওয়ার পরই এ সংঘাতের ঘটনা ঘটে। ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারে এমন কয়েকজন অভিবাসী জানান, কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে তিনটি-চারটি নৌকা ছেড়ে আসে। থাইল্যান্ডের উপকূলে আসার পর পাচারকারীরা তাদের একটি বড় নৌকায় তোলে। গত সপ্তাহে তাদের নৌকা ইন্দোনেশিয়ার জলসীমা প্রবেশ করে কিন্তু নৌবাহিনী তাদের নামতে দেয়নি। বাংলাদেশি আবদুর রহিম বলেন, ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী তাদের মালয়েশিয়ার জলসীমায় পাঠিয়ে দেয়। মালয়েশিয়া যাওয়ার পর একই ধরনের আচরণ দেখতে পাই। মালয়েশিয়া ফেরত পাঠানোর পর ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় নৌকাটি ডুবতে বসলে জেলেরা তাদের উদ্ধার করে। উদ্ধার হওয়া এসব অভিবাসীরা পানি শূন্যতা ও অপুষ্টিতে ভুগছে। আবদুর রহিম বলেন, আমরা শিগগিরই বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই। আমাদের সহায়তা করুন।

অভিবাসী সঙ্কটের দায় নেবে না মিয়ানমার: মিয়ানমারের সরকার জানিয়েছে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সাগরে অভিবাসীদের নৌকায় ঝুঁকিতে থাকা রোহিঙ্গা অভিবাসীদের বিষয়ে তাদের কোনো দায়িত্ব নেই। দেশটির প্রেসিডেন্টের দপ্তর বলেছে, এ বিষয়ে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলেও আমন্ত্রণপত্রে রোহিঙ্গা শব্দের উল্লেখ থাকলে মিয়ানমার তাতে যোগ নাও দিতে পারে। অভিবাসীদের এই সংকটের বিষয়ে আলোচনার জন্য আগামী ২৯ মে ১৫টি দেশকে নিয়ে এই জরুরি বৈঠকের ডাক দিয়েছে থাইল্যান্ড। ব্যাংকক সম্মেলনে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যোগ দেবেন বলে জানা গেছে। এছাড়া এই সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন অস্ট্রেলিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস, যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনামের প্রতিনিধিরাও।

আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারে সম্মত বাংলাদেশ: এদিকে মানবপাচার বন্ধে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হতে শুরু করেছেন মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিফাহ আমান। গতকাল রোববার  এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর সাথে এক যৌথ কমিশন বৈঠকে মিলিত হন আনিফাহ। মালিয়েশিয়ার বোর্নিও দ্বীপের সাবাহ প্রদেশের কোতা কিনাবালু শহরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে মানবপাচার রোধে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারে একমত হন দুই দেশের মন্ত্রী। আজ সোমবার ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মার্সুদির সাথে ও চলতি সপ্তাহের শেষদিকে থাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেনারেল তানাসাক পাতিমাপ্রাগর্নের সাথেও মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠকে বসবেন বলে জানিয়েছে মালয়েশীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সমুদ্রে আটকে পড়াদের প্রায় অর্ধেকই বাংলাদেশি: ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, আন্দামান সাগরে আটকে পড়া অবৈধ অভিবাসীদের অর্ধেকই বাংলাদেশি। তারা অর্থনৈতিক কারণেই দেশান্তরি হয়েছে। বাকি অর্ধেক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। বহুদিন ধরে নিপীড়িত হওয়া এ সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে বিতাড়িত করতে চায় রাখাইন প্রদেশের বহু কর্মকর্তা ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত মানব পাচারকারীদের ক্যাম্পে যাওয়ার বিনিময়ে দালালদের ২ হাজার ডলার করে দিয়েছে এসব অভিবাসীরা। এখান থেকে তারা সীমান্ত পেরিয়ে মালয়েশিয়ায় ঢুকে যাওয়ার আশায় ছিলো। এটা খুবই দীর্ঘ ও বিপজ্জনক যাত্রা। অনেকেই রোগে ভুগে কিংবা থাই বন্দিশিবিরে মারা যায়। প্রায়ই তাদের আটকে রেখে পরিবার বা বন্ধুদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে পাচারকারীরা। অনেকেই দাস হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয় থাই মাছ ধরার বিভিন্ন নৌকায়। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছরের প্রথম তিন মাসে সাগরে ৩০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।