মাধ্যমিক পর্যায়ে ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর সৃজনশীল প্রশ্ন বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ প্রকল্পের জরিপ

 

স্টাফ রিপোর্টার: মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর সৃজনশীল প্রশ্ন বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। এ সকল শিক্ষার্থীর অধিকাংশই গ্রামের বিদ্যালয়ের। মূলত সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির যে চারটি ধাপ রয়েছে, জ্ঞানমূলক, অনুধাবনমূলক, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা, তার মধ্যে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানমূলক ও অনুধাবনমূলক বিষয়ের ওপর প্রশ্ন ভালোভাবে উত্তর দিতে পারলেও প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতামূলক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে গণিত বিষয়ে ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ, ইংরেজি বিষয়ে ৮ দশমিক ২ শতাংশ এবং ও বিজ্ঞান বিষয়ে ৩৩ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে বিষয়গুলো দুর্বোধ্য।

মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নে নেওয়া সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভেলমেন্ট প্রজেক্ট (এসইএসডিপি) এর প্রভাব মূল্যায়নে করা জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকল্পটির প্রভাব মূল্যায়ন করতে এ জরিপটি করেছে। জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৫ ও ২০১৭ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার মূল কারণ গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজিতে কম নম্বর পাওয়া। ফলে শিক্ষার্থীদের ৫৯ দশমিক ৮ শতাংশ উক্ত বিষয়গুলো বুঝতে প্রাইভেট পড়তে হয় এবং গাইড বই অনুসরণ করতে হয়।

মূলত দারিদ্র্য বিমোচনের   লক্ষ্যে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারের চাহিদা পূরণের উপযোগী মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলাই হচ্ছে এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য যা ৭৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে, মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি, মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন, মাধ্যমিক শিক্ষায় সকলের সম-অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যামিক শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

প্রভাব মূল্যায়নে জরিপ করার জন্য ৮টি বিভাগ হতে আনুপাতিক হারে ২১টি জেলার মাধ্যমিক পর্যায়ে মোট ৭৬৮ জনকে নির্বাচিত করা হয়। মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি সম্প্রতি চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনের সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কার করে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি প্রণয়নে এখনো কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। তবে জরিপকালে ৭০ ভাগ শিক্ষক বলেছেন, সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি ও পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের ফলে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়া, কোচিং এ যাওয়া ও বই মুখস্ত করার প্রবণতা কমেছে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের মতে শিক্ষকদের ৪০ ভাগ তাদের প্রাইভেট পড়তে উত্সাহিত করেন বলে জরিপকালে জানিয়েছে।

সমীক্ষা প্রতিবেদনে উপবৃত্তি প্রসঙ্গে শিক্ষকদের মতামত বিশ্লেষণ করে উল্লেখ করা হয়েছে, ৯৫ দশমিক ৪ ভাগ শিক্ষক বলেছেন উপবৃত্তির ফলে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তির হার বেড়েছে এবং মেয়েদের বাল্যবিয়ে অনেকটা রোধ হয়েছে। ৯১ ভাগ শিক্ষক বলেছেন, ঝরেপড়ার প্রবণতা কমেছে। এই বৃত্তির মাধ্যমে গরিব ও হতদরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে ছাত্রীরাই বেশি উপকৃত হয়েছে। প্রায় ৭৮ ভাগ উপবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থী বলেছেন, উপবৃত্তির অর্থ তারা মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে পেয়েছেন। ৮৫ ভাগ শিক্ষার্থী বলেছেন, যদি উপবৃত্তির টাকা তারা নাও পায় তবুও তারা পড়াশুনা চালিয়ে যাবে।

সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী ৯২ দশমিক ৩ ভাগ বিদ্যালয়ে লাইব্রেরি রয়েছে এবং প্রায় ৬৯ ভাগ শিক্ষার্থী লাইব্রেরি ব্যবহার করছে। লাইব্রেরি ব্যবহার সংক্রান্ত বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৪ ভাগ মনে করে লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই। ২০ ভাগ বলেছে কোনো লাইব্রেরি নেই। ১৪ ভাগ বলেছে লাইব্রেরি বন্ধ থাকে। যদিও শিক্ষকদের মধ্যে ৮৩ ভাগ তাদের শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরি ব্যবহারে উত্সাহিত করেন। তবে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের প্রায় ৩৬ ভাগ বিজ্ঞানাগার ব্যবহার করে না বলে জানিয়েছে।

মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষাক্রম পরিমার্জন, আধুনিকায় ও সময়োপযোগী কারিকুলাম অনুসারে পাঠ্যপুস্তক তৈরির ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান বিশেষ করে তথ্য প্রযুক্তি জগতে ক্রমশ পরিবর্তনের সূচনা ঘটেছে। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা তথা পাঠদান পদ্ধতি নিশ্চিত করার জন্য সমীক্ষার আওতাভুক্ত অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। সমীক্ষায় প্রায় ৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন তাদের বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তবে ২৩ ভাগ শিক্ষার্থী বলেছে প্রশিক্ষিত শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও এদের ৬০ ভাগ শিক্ষার্থী কিভাবে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয় তা জানে না। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কম্পিউটারগুলো নষ্ট হচ্ছে। এগুলো মেরামত করার জন্য দক্ষ জনবল ও অর্থের কোনো সংস্থান রাখা হয়নি। কম্পিউটার ল্যাবে ইন্টারনেট ব্যবহারে রাউটার থাকলেও সংযোগের অভাব অনেক বিদ্যালয়ে নেই। অনেক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজ উদ্যোগে এবং কিছু কিছু বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি নিয়ে ই-লার্নিং ব্যবস্থা সচল রেখেছে। এ ছাড়াও শিক্ষকদের মাত্র ৬ দিনের প্রশিক্ষণ ও আইসিটি উপকরণ মোটেও ই-লার্নিং পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত ছিলো না বলে মনে করেন।

প্রতিবেদনের সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে মাধ্যমিক শিক্ষার টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে এই প্রকল্পটি ২০২৪ সাল পর্যন্ত চলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই বিবেচনায় দীর্ঘমেয়াদী কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। উপবৃত্তি দেয়ার ক্ষেত্রে প্রকৃত উপকারভোগী যাতে বাদ না পরে সেজন্য কমপক্ষে ২৫ ভাগ তথ্য প্রদানকারী শিক্ষার্থীর বাড়ি দৈব চয়ন পদ্ধতীতে বাস্তব অবস্থা জানতে হবে। মোবাইলফোন থাকলে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির আওতায় বিবেচনা করা হয় না। কিন্তু মোবাইলফোন একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। দারিদ্র্যতা নিরূপণের মাপকাঠিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথচ বর্তমানে প্রায় সব শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা দেয়া হচ্ছে মোবাইল একাউন্টের মাধ্যমে।