মাদকের জগতে আরও একটি ভয়ঙ্কর নাম ইয়াবা

 

ইয়াবা ট্যাবলেটে সয়লাব দর্শনাসহ আশপাশ এলাকা

দর্শনা অফিস: দর্শনায় ফেনসিডিলের পাশাপাশি ইয়াবা কারবারীদের সংখ্যা দিনদিন ব্যপকভাবে বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে ফেনসিডিল ও ইয়াবা আসক্তদের সংখ্যা। যতোই দিন যাচ্ছে, ততোই যেন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে। পুলিশ প্রসাশন যখন ফেনসিডিল কারবারীদের সায়েস্তা করতে ব্যস্ত ঠিক সে সময় কাজে লাগিয়েছে এক শ্রেণির চতুর প্রকৃতির অসাধু মাদককারবারী। হেরোইন ও ফেনসিডিলের মারণ ছোবলে যুবসমাজ যখন বিপযস্ত্র, ঠিক তখনই ইয়াবার মতো ভয়ংকর নেশাযাত ট্যাবলেট ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে গোটা দেশে। ইয়াবার বিষাক্ত ছোবলে নীল হচ্ছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে উঠতি বয়সের যুবসমাজ। মাদকদ্রব্য ছিলো এবং ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে। একালের মাদকদব্য সেকালের তুলনায় অনেক ভয়ংকর। এক সময় জমিদার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা মদের নেশা করতো। সাধু ও ফকিররা সিদ্ধি সাধনের জন্য সেবন করতো গাঁজা, অল্প আয়ের মানুষরা নেশা করতো খেজুর বা তালের রসের তৈরি তাড়ি। তাতেই সংসারে বাড়তো অশান্তি। গণ্য করা হতো বড় ধরনের অপরাধে। সময়ের সাথে সাথে পাল্টেছে নেশাজাতদ্রব্য। এখন হাতেগোনা গুটি কয়েকজন মদ, গাঁজা ও তাড়ির নেশা করে থাকে। বাংলাদেশের যুবসমাজকে ধ্বংস করতে প্রতিবেশী দেশ আবিষ্কার করলো ফেনসিডিল নামক মাদকজাত। প্রায় ১ যুগ আগে এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি সীমান্তের তার কাঁটাবেড়া ডিঙিয়ে বাংলাদেশে আনা শুরু করে ফেনসিডিল ও হেরোইন। নামকাওয়াস্তে মূল্যে ফেনসিডিল বিক্রি হলেও এ নেশা যুবসমাজে ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। সেই সাথে মরণ নেশা হেরোইন ও ফেনসিডিল ধ্বংসাত্মক ভয়ংকর নেশায় পরিণত হয়েছে। ফেনসিডিল রোধে চুয়াডাঙ্গা বিজিবি ও পুলিশ যখন সোচ্চার ভূমিকা গ্রহণ করেছে। তখনো থেমে নেই ইয়াবা কারবারীচক্র। এবার শুরু হয়েছে আরো একটি ভয়ংকর নেশাযাত ট্যাবলেট ইয়াবার কারবার। পাচার ও বহনে সহজ ইয়াবা ট্যাবলেট যেন সমাজের কোষে কোষে প্রবেশ করেছে। অভিযোগে উঠেছে, দর্শনা পৌর শহরের শান্তিপাড়া, হল্টস্টেশনপাড়া, ঈশ্বরচন্দ্রপুর, জয়নগর, কেরুজ এলাকা, আনোয়ারপুর, রামনগর, পরাণপুরসহ বিভিন্ন মহল্লায় ইয়াবা কারবারীর সংখ্যা অগণতি। থাইল্যান্ড থেকে মিয়ানমার সীমান্ত পথে চট্রগ্রাম হয়ে বহন করে আনা হয়ে থাকে মারণজাত নেশার ট্যাবলেট ইয়াবা। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা তৈরির কারখানা তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশে তৈরি ইয়াবার নামকরণ করা হয়েছে চম্পাকলি, আর সেভেন, গুটি ও বিচি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করে আনা হয়ে থাকে এ শহরে। ইয়াবা ট্যাবলেট (গুটি) বহনে অতিসহজ হওয়ায় অনেকটাই নির্ভয়ে এ কারবার করছে অনেকেই। মাঝে মধ্যে ইয়াবাসহ বহনকারী চুনোপুটিরা পুলিশ-বিজিবির হাতে ধরা পড়লেও তাদের বেশিদিন জেলের ঘানি টানতে হয়না। বহনকারীদের পেছনে থাকা রুই কাতলারা তাদের জামিনে মুক্তিকরণের ব্যবস্থা করে থাকে। ফলে তিমিরেই রয়ে যায় রাঘব বোয়ালেরা।

একটি পরিসংখ্যানে জানা গেছে, চলতি বছরেই শুধু বিজিবি কর্তৃক ১শ কোটিরো বেশি টাকার ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করেছে। বর্তমান সমাজে ইয়াবা আসক্তকারীর সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে, উঠতি বয়সের যুবক-যুবতি ও অপ্রাপ্ত এবং প্রাপ্ত বয়স্করা ইয়াবা নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। ফেনসিডিলের মতোই সমাজের প্রভাবশালী ও বিত্তবান পরিবারের ছেলে-মেয়েরা ইয়াবা নেশায় আসক্ত হয়ে পড়লেও লোকলজ্জায় অনেকেই মুখ খোলেনা। দর্শনাসহ আশপাশ এলাকা ইয়াবার ধোয়ায় সমাজ দূষিত হয়ে পড়েছে। ইয়াবার নীল ছোবল থেকে মুক্তি চায় দর্শনাবাসী। মাদককারবারীরা অদৃশ্য খুটির জোরেই অপশক্তিশালী হওয়ায় সমাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনা সুধী সমাজের ব্যাক্তিরা। প্রতিরোধ-প্রতিবাদ করা হলে কলূষমুক্ত সমাজ গড়া সম্ভব হলেও বাড়তি ঝামেলায় নিজেকে জড়ানো থেকে অনেকেই বিরত থাকতে চায়। নিত্য নতুন কৌশলে ইয়াবা কারবারীরা পুরোদমে তাদের ধান্দা চালিয়ে সমাজ ধ্বংস করছে। ইয়াবা কারবারের সাথে জড়িয়ে যেমন অপরাধির তালিকায় অন্তর্ভুক্তি হচ্ছে অনেকেই, তেমনি ইয়াবা নেশার দিকে ঝুঁকে পড়েছে মারণ পথে এগিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য মাদকসেবী। সমাজকে ইয়াবামুক্তকরণে এখনই জোরালো ভূমিকা না নিলে অচিরেই এ ধ্বংসাত্মক নেশাজাত ট্যাবলেট ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে, কলূষিত হবে গোটা সমাজ। ফলে ইয়াবা কারবারী ও আসক্তকারীদের চিহ্নিত করে পুলিশে সোপর্দ করে সামাজিক দায়বদ্ধতায় নিজেকে নিয়োজিতকরণের সময় এসেছে বলেই মন্তব্য সচেতন মহলের। এ দিকে ফেনসিডিলের পাশাপাশি ইয়াবার দিকে ঝুঁকে পড়েছে নেশাখোররা। চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন এলাকা থেকে ইয়াবা ট্যাবলেটের নেশার জন্য দর্শনায় ভিড় জমাচ্ছে আসক্তকারী ও কারবারীরা। ইয়াবাকারবারীদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশকে কদিন ছোটাছুটি করতে দেখা গেলেও বর্তমানে নিশ্চুপ। কেন কি কারণে পুলিশ নিশ্চুপ তা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। ইয়াবা আসলে কী? এর মূল শব্দ থাইল্যান্ড থেকে উৎপত্তি। সংক্ষিপ্ত অর্থে বলা হয় পাগলা ওষুধ। অনেকে একে বলে ক্রেজি মেডিসিন। মূল উপাদান মেথঅ্যামফিটামিন। এটি একটি নেশা জাতীয় ওষুধ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইয়াবাকে ভিন্ন ভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন, হিটলার চকলেট, ক্রেজি মিডিসিন, হিটলারস্ ড্রাগ, সাবু, বুলবুলিয়া, ইন্ডিয়াতে বলে ভুলভুলাইয়া, ফিলিপাইনে ও ইন্দোনেশিয়ায় বলে শাবু, উত্তর থাইল্যান্ডে এর নাম চাকোস, সাউথ আফ্রিকায় বলে টিংকু, ব্রাজিলে বলা হয় বালা। বাংলাদেশ ও ভারতের কোনো কোনো এলাকায় ইয়াবাকে বাবা এবং গুটিসহ ইত্যাদি নামে নামকরণ করা হয়েছে। যদি ও নতুন ড্রাগ সেবনকারীদের ক্ষেত্রে ড্রাগ আসক্তি পূর্ণতা পেতে একটু বেশি সময় লাগে। পুরাতন সেবনকারীদের ক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টা পর যখন ইয়াবার কার্যক্ষমতা হারিয়ে যায়, তখন মস্তিষ্কে সেরোটোনিন এতোটা বৃদ্ধি পায় যে আসক্তকারীর মেজাজে একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। ফলে পুনরায় ড্রাগ সেবন করার জন্য পাগল হয়ে ওঠে। অর্থাৎ তখন নিউরো জংশনসমূহে হরমোন নিঃসরন বন্ধ হয়ে যায় বা কমে যায়। সে কারণে ইয়াবা নেশার জন্য যেকোন ধরনের মারাত্মক অপরাধের পথে হাঁটতেও দ্বিধাবোধ করেনা ইয়াবাসক্তরা। ইয়াবা কোকেনের সমপর্যায়ে স্নায়ু বিক উক্তেজক (নারকটিক্স) ও হরমোন স্টিমউলট। তবে ইয়াবা সেবনকারী কঠোর নিয়ম মেনে চলতে পারলে ৮০ ভাগ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেক্ষেত্রে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা করা উচিত। সেই সাথে সাইকোথেরাপি ও অন্যান্য উপায়ে ইয়াবাসক্তকারীকে স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনযাপন পদ্ধতিতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে কোনো অবস্থায় যেন আগের পথে না হাঁটতে পারে। তবেই সম্ভব ইয়াবাসক্তিকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরিয়ে আনা। দর্শনাবাসী ইয়াবাকারবারী ও আসক্তকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তুলেছে চুয়াডাঙ্গা-৬ বর্ডার গার্ডের পরিচালক ও চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপারসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্তাদের কাছে।