মন মজেছে লালনের গানে

 

স্টাফ রিপোর্টার: মৃত্যু হয়েছে ১২৪ বছর আগে। বেঁচে ছিলেন প্রায় ১১৬ বছর। এই দীর্ঘ সময়েও বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাননি। বরং তার সৃষ্টির ঔজ্জ্বল্য বেড়েছে, বেড়েছে পরিধি। ফকির লালন শাহ দু শতাব্দীরও বেশি সময় জুড়ে এক ঐন্দ্রজালিক মোহময়তা বিস্তার করে চলেছেন। অগণিত মানুষ তার বিশাল সৃষ্টি জগতে প্রবেশ করে সন্ধান করছেন যেন তাকেই। গতকাল বৃহস্পতিবার কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন শাহের ১২৪ তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শুরু হয়েছে পাঁচ দিনব্যাপি লালন স্মরণ উত্সব। সারা দেশ থেকে আসা লালন অনুসারীদের মিলনমেলায় জমে উঠেছে আখড়াবাড়ি ছেঁউড়িয়া।

ফকির লালন শাহ তাঁর গানের বাণীর ভেতর দিয়ে একটি সুসংবদ্ধ জীবন বিধানের নির্দেশনা দিয়েছেন। তার গান এক গভীর দ্যোতনায় এই বিশ্ব-সংসার, মানবধর্ম, ঈশ্বর, ইহলৌকিক ও পারলৌকিকতা সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে বাধ্য করে। দু শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আজো লালন মরমী জগতের সার্বভৌম ব্যক্তিত্ব। লালন উত্সবে আসা বাউলসাধক কফিল শাহ বললেন, লালনের গানে সবার উপরে রয়েছে মানুষ। সবকিছুর সন্ধান পাই তার গানে। কোরান, বেদ, মানবধর্ম, জগতের সকল ভাবনার উত্তর। কিন্তু লালনকে বুঝতে পারি না। সারা জীবন ধরে লালনেরই সন্ধান করে চলেছি। ফকির কেরামত শাহ বললেন, মহাগুরু ফকির লালন সাঁই বিশ্ব মানবতার প্রতীক। তাই প্রতি বছর আমি এখানে আসি। আখড়ায় গিয়ে দেখা গেলো, অগণিত বাউল-সাধকদের ভিড়ে ভরে উঠেছে গোটা এলাকা। তারা পরিবার, ভক্তদের নিয়ে লালনের মাজার ও কালীগঙ্গা নদীর পাড় জুড়ে আসন পেতে বসেছেন। লালনের গানে, একতারার বোলে সবাই ভক্তি জানাচ্ছেন। স্থানে স্থানে সাধকরা জটলা করে দোতরা ও মন্দিরা বাজিয়ে গানের সুরে যেমন নিজেরা মজে গেছেন, তেমনি লালনের বাণী ও সুরে মাতোয়ারা করে তুলছেন ভিড় করে থাকা শ্রোতাদের। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ যেন এক মহামিলন মেলায় যুক্ত হয়েছেন।

লালন ভক্ত অধ্যাপক ড. অনুপম হাসান বললেন, ‘লালন ফকির নির্দিষ্ট কোনো ধর্মমত বা জাতপাত ও বর্ণে বিশ্বাস করতেন না; বরং সকল ধর্মের সমন্বিত ধর্মীয় মতবাদই তার গানে প্রচারিত হয়েছে। লালন সমন্বিত ধর্মীয় মতাদর্শের মধ্য দিয়ে মানবধর্মকেই বড় করে দেখেছেন।’

গতকাল ভোর থেকেই দেশের সব অঞ্চলতো বটেই বিদেশি সাধু-ভক্তরা পর্যন্ত এসে প্রথমে কালীগঙ্গা নদীতে স্নান করেন। এরপর সাঁইজির মাজারে ভক্তি প্রদর্শন করেন। প্রতিবারের মতো এবারও সাধু ভক্তরা বাল্যসেবা, পুণ্যসেবা ও অধিবাস চরম ভক্তির সাথে গ্রহণ করেন। দুপুরে আখড়াবাড়ির মূল আঙিনায় অবস্থানরত লালনের ভক্ত-শিষ্যরা পুণ্যসেবা (দুপুরের খাবার) গ্রহণ করেন। কলাপাতায় দেয়া হয় শাদা ভাত, ইলিশ মাছ, সবজি, ডাল আর দই। সন্ধ্যায় ফকির লালন শাহের ১২৪তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। বিশেষ অতিথি ছিলেন আব্দুর রউফ এমপি, কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার প্রলয় চিসিম, জেলা পরিষদের প্রশাসক জাহিদ হোসেন জাফর প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির সভাপতি সৈয়দ বেলাল হোসেন। এদিকে লালন একাডেমীর আয়োজনে লালনের মূল মাজারের সামনে কালীগঙ্গা নদীর তীরে বসেছে লালন মেলা। এতে স্থান পেয়েছে লালনের প্রতিকৃতি, একতারাসহ নানা হস্তশিল্প সামগ্রী।

বাংলা ১২৯৭ সনের পহেলা কার্তিক, ইংরেজি ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর ফকির লালন সাঁই দেহত্যাগ করেন। সাঁইজির তিরোধানের পর থেকে ভক্ত-শিষ্যবৃন্দ প্রতি বছর পহেলা কার্তিক থেকে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়িতে পাঁচ দিনব্যাপি এ স্মরণোত্সব পালন করেন।