মন্ত্রী-এমপিরা সরকারি সুবিধা পাবেন না

স্টাফ রিপোর্টার: নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন না- এমন বিধান রেখে নির্বাচনী আচরণবিধির খসড়া প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। খসড়া আচরণবিধিতে ‘নির্বাচনপূর্ব সময়’র সংজ্ঞাতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন কিংবা কোনো আসনে উপনির্বাচনের ক্ষেত্রে কমিশন কর্তৃক তফসিল ঘোষণার দিন হইতে নির্বাচনের ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রকাশের তারিখ পর্যন্ত সময়কাল। বিদ্যমান আচরবিধিতে এর সংজ্ঞায় রয়েছে (অ) সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে, সংসদের মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়ার পর হইতে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রকাশের তারিখ পর্যন্ত সময়কাল; (আ) উপনির্বাচনের ক্ষেত্রে, সংসদের কোনো আসন শূন্য ঘোষণা হইবার পর হইতে উক্ত আসনের জন্য অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনের ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রকাশের তারিখ পর্যন্ত সময়কাল।

সূত্র জানায়, বিদ্যমান আচরণবিধিতে নির্বাচনের সময়কাল ৯০ দিন। এ সময় কমিয়ে খসড়া আচরণবিধিতে এখন ৫০ থেকে ৫৫ দিনের মধ্যে রাখা হয়েছে।

জানা গেছে, তফসিল ঘোষণার আগে রাজনৈতিক সহিংসতা ও অনিয়মের আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের সহিংসতার দায়ভার নিতে চায় না ইসি। ফলে নির্বাচনী সময় কমানোর এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সংসদ নির্বাচনের জন্য ৪৫ দিন সময় দিয়ে তফসিল ঘোষণা করা হবে। গেজেট প্রকাশসহ নির্বাচনের মোট সময় হবে ৫৫ দিন। গতকাল বুধবার শেরেবাংলা নগরের ইসি সচিবালয়ে আচরণবিধির খসড়া প্রকাশ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেন, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সরকার শুধু তার রুটিন কাজ করতে পারবে। কোনো নীতিনির্ধারণী বা বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। প্রশাসনেও কোনো ধরনের পরিবর্তন বা রদবদল আনতে হলে সেক্ষেত্রে কমিশনের পরামর্শ নিতে হবে। সিইসি বলেন, বর্তমানে যে আচরণবিধিটি আছে, সেটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের আদলে তৈরি। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের উপযোগী করে আচরণবিধি পরিবর্তন করা হয়েছে। সিইসি আরো বলেন, ইন্টারনেটে আপলোড করার পর দেশে-বিদেশের যে কোনো নাগরিক এ আচরণবিধির ওপর তার মতামত জানাতে পারবেন। এজন্য তাদের সাত দিন সময় দেয়া হবে। সবার মতামত পাওয়ার পর আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং (যাচাই-বাছাই) শেষে চূড়ান্ত আচরণবিধি অনুমোদন করা হবে।

সিইসি বলেন, মন্ত্রীরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নির্বাচনী প্রচার বা অন্য কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারবেন না। তবে মন্ত্রীরা নিজের এলাকার বাইরে অন্য কোনো আসনে গিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারলেও সেখানে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন না। তফসিল ঘোষণার ব্যাপারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, কমিশন সঠিক সময়ে তফসিল ঘোষণা করবে এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য সবাইকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া হবে। খসড়া আচরণবিধির ৩ ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনপূর্ব সময় কোনো ধরনের প্রকল্পের অনুমোদন, ফলক উন্মোচন, ইত্যাদি সংক্রান্ত বিধান সন্নিবেশ। উক্ত বিধিমালার বিধি ৩-এর পর নিম্নরূপ বিধি ৩-ক সন্নিবেশ হবে, যথা- নির্বাচনপূর্ব সময় প্রকল্প অনুমোদন, ফলক উন্মোচন, ইত্যাদি নিষিদ্ধ। এ সময় সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রাজস্ব বা উন্নয়ন তহবিলভুক্ত কোনো প্রকল্পের অনুমোদন, ঘোষণা বা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন কিংবা ফলক উন্মোচন করা যাইবে না। এই সময়ে সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি স্বেচ্ছাধীন সরকারি বা আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের তহবিল হতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কোনো প্রকার অনুদান ঘোষণা বা বরাদ্দ প্রদান বা অর্থ অবমুক্ত করতে পারবেন না।

খসড়া আচরণবিধির ১৪ বিধিতে বলা হয়েছে, সরকারি সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গের নির্বাচনী প্রচারণা সম্পর্কে এ বিধিতে ৬টি ধারা রয়েছে। তাহলো ১. সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাহার সরকারি কর্মসূচির সঙ্গে নির্বাচনী কর্মসূচি যোগ করিতে পারিবেন না। ২. সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ তাহাদের নিজেদের বা অন্যদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় যান, সরকারি প্রচারযন্ত্রের ব্যবহার বা অন্যবিধ সরকারি সুবিধাভোগ করিতে পারিবেন না এবং এ উদ্দেশ্যে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী বা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ব্যবহার করিতে পারিবেন না। ৩. কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তাহার নির্বাচনী এলাকায় সরকারি উন্নয়ন কর্মসূচিতে কর্তৃত্ব করা কিংবা এ সংক্রান্ত সভায় যোগদান করিতে পারিবেন না। ৪. কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কর্তৃক কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে পূর্বে প্রদত্ত মনোনয়ন হইয়া থাকিলে নির্বাচনপূর্ব সময়ে উহা অকার্যকর থাকিবে। ৫. সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ভোটদান ব্যতিরেকে নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ কিংবা নিজে প্রার্থী না হইলে ভোট গণনার সময় গণনা কক্ষে প্রবেশ বা উপস্থিত থাকিতে পারিবেন না। ৬. জাতীয় সংসদের কোনো শূন্য আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবার ক্ষেত্রে সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনপূর্ব সময়ের মধ্যে কোনো সফর বা নির্বাচনী প্রচারণায় যাইতে পারিবেন না। তবে ভোটার হইলে কেবল ভোট দিতে যাইতে পারিবেন।

এদিকে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তার দিকে তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। আর সেক্ষেত্রে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোটগ্রহণ হবে। সিইসি বলেন, ৪০ থেকে ৪৫ দিন হাতে রেখে ২৪ জানুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন হবে। কমিশন মনে করছে, জানুয়ারির প্রথমার্ধই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময়।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে আসনভিত্তিক ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের তালিকা চূড়ান্ত করা এবং ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের নিয়োগের কাজও এগিয়ে চলছে। মনোনয়ন ফরমসহ বেশিরভাগ ফরম ছাপার আদেশ কয়েক সপ্তাহ আগেই দেয়া হয়েছে। নতুন করে ৪০ হাজার স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স আমদানির কাজও শেষ হয়েছে। সবশেষ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট নেয়া হলেও ওই নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার পর দুই বছর ভোট হয়নি। সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নবম সংসদ নির্বাচনের জন্য এম এ আজিজ কমিশন পাঁচবার তফসিল পরিবর্তন করে। পরে ড. এটিএম শামসুল হুদার কমিশনও তিনবার তফসিল পরিবর্তন করে।

দশম সংসদ নির্বাচনও জানুয়ারির প্রথমার্ধে করার পরিকল্পনা নিয়ে কমিশন এগোলেও দলীয় বা সর্বদলীয় কোনো ধরনের সরকারের অধীনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন যাবে না বলে ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। ফলে জানুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের তারিখ ঠিক করে তফসিল ঘোষণা হলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন সঠিক সময় হবে কি না-তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

এদিকে নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে সরকারি ও বিরোধী জোটের বিপরীতমুখী অবস্থানে রাজনৈতিক অস্থিরতা চললেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আগামী ১০ নভেম্বর থেকে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করবে বলে জানা গেছে।