মন্ত্রীর ফোনে বিব্রত : বিচারপতি বন্ধ করে দিলেন মামলার শুনানি

স্টাফ রিপোর্টার: ব্যাংকের ঋণসংক্রান্ত একটি সিভিল রিভিশন মামলার শুনানিকালে তদবিরের জন্যে হাইকোর্ট বিভাগের এক বিচারপতিকে ফোন করেছেন বর্তমান সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী। এ কারণে মামলার শুনানি না করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মামলার ফাইলটি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো হয়েছে। গতকাল সোমবার বিচারপতি শরিফ উদ্দিন চাকলাদার ও বিচারপতি একেএম সাহিদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ফাইলটি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠান। তবে আদেশে কোনো মন্ত্রীর নাম উল্লেখ করা হয়নি।

এ মামলার একপক্ষের আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ৩৬৪/২০১৩ সিভিল রিভিশন মামলাটি এর আগেও বিচারপতি শরিফ উদ্দিন চাকলাদারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে শুনানি হয়েছে। গতকাল সোমবার মামলাটি শুনানির জন্যে ওই বেঞ্চের কার্যতালিকায় আংশিক শ্রুত (২২ নম্বর) আইটেম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিলো। কিন্তু একজন বিচারপতির কাছে একজন মন্ত্রী ফোন করায় তা শুনানি না করে ফাইলটি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

হাইকোর্ট তার আদেশে বলেছেন, ‘এ মামলার শুনানিকালে একজন মন্ত্রী আমার কাছে ফোন করেছিলেন। যার কারণে আমরা এ মামলার শুনানি করতে ইচ্ছুক নই। এ মামলার ব্যাপারে পরবর্তী উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যে ফাইলটি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো হলো’। সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শশাঙ্ক শেখর সরকারের কাছে এ বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেছেন, আমি ২২ নম্বর আইটেমের শুনানির সময় বেঞ্চে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু প্রাইভেট (ব্যক্তিগত) মামলা হওয়ায় এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারবো না।

এদিকে বিচারপতিকে মন্ত্রীর ফোনের খবর ছড়িয়ে পড়লে সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে আলোচনার ঝড় ওঠে। অনেকেই মন্ত্রীকে মূর্খ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। একজন সিনিয়র আইনজীবী বলেন, একজন মন্ত্রীর ফোন করার আগে ভাবা উচিত ছিলো, তিনি কাকে ফোন করছেন। এ রকম মূর্খতা দেখা যায় না। সরকারের একজন আইন কর্মকর্তাও ওই মন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা করেন। ওই আইন কর্মকর্তা বলেন, সরকারকে ডোবানোর জন্যেই এ ধরনের মূর্খতা। আর মন্ত্রীর ফোন পেয়ে বিব্রত হওয়ার কারণেই বিচারপতিরা মামলার শুনানি না করে ফাইল প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট মামলার আইনজীবীর কাছ থেকে প্রাপ্ততথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি ব্যাংক ‘যমুনা ব্যাংক লিমিটেড’ থেকে ২০০৬ সালের ৩১ জুলাই ‘জারিফ ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি কোম্পানি ৭০ লাখ টাকা ঋণ নেয়। এ ঋণের জামিনদার হিসেবে ব্যাংকের কাছে এসএমএ মুহিত ও ‘বরেন্দ্র ইন্টারন্যাশনালের’ মালিকানাধীন রাজধানীর মোতালেব প্লাজার ৫টি অ্যাপার্টমেন্ট বন্ধক রাখা হয়। কিন্তু ওই ঋণ পরিশোধ না করায় যমুনা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ২০০৯ সালের ১৬ এপ্রিল জারিফ ইন্টারন্যাশনালসহ জামিনদারদের কাছে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। নোটিশে ব্যাংকের পাওনা বাবদ ৮৪ লাখ ৮৪৫ টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়। কিন্তু ঋণ পরিশোধ না করায় একই বছরের ২২ জুলাই যমুনা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় লিগ্যাল নোটিশ দেয়। এ নোটিশে ২ কোটি ১৭ লাখ ৫ হাজার টাকা পাওনা দাবি করে ব্যাংকটি। তিন মাসের ব্যবধানে পাওনার বিষয়টি এতে বেশি হওয়ায় ঋণগ্রহীতা পক্ষ ব্যাংকের সাথে আলোচনা করতে থাকে। আইনজীবীর ভাষ্য অনুযায়ী হিসাব-নিকাশ চলাবস্থায় ২০১০ সালের ১৩ জুলাই ওই অ্যাপার্টমেন্টগুলো অকশনে বিক্রির জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় এবং সেখানে পাওনা ৮৭ লাখ ৬৪ হার টাকা উল্লেখ করা হয়।

এ অবস্থায় দ্বিতীয় লিগ্যাল নোটিশের (২০০৯ সালের ২২ জুলাই প্রেরিত) বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জারিফ ইন্টারন্যাশনালের মালিক আতাউর রহমান ২০১১ সালে হাইকোর্টে রিট করেন। এ রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ৮৪ লাখ টাকা পরিশোধ করার শর্তে অকশন (নিলাম) বিজ্ঞপ্তির কার্যকারিতা স্থগিত করেন এবং রুল জারি করেন।

এ আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জারিফ ইন্টারন্যাশনাল দুটি চেকের মাধ্যমে ২০১১ সালের ২১ আগস্ট ওই টাকা পরিশোধ করেন। এরপর যমুনা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একই বছরের ৮ সেপ্টেম্বর চিঠির মাধ্যমে জারিফ ইন্টারন্যাশনালকে জানায় ২০১১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ওই অ্যাপার্টমেন্টগুলো অকশনে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় ২০১২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঋণ পরিশোধের জন্যে যমুনা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের দেয়া লিগ্যাল নোটিশ, নিলামে বিক্রয়- এসব বাতিল চেয়ে নিম্ন আদালতে সিভিল মামলা করে ঋণগ্রহীতা জারিফ ইন্টারন্যাশনাল ও ঋণের জামিনদার এসএমএ মুহিত এবং বরেন্দ্র ইন্টারন্যাশনাল। এ মামলায় যমুনা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়। মামলার অভিযোগে বলা হয়, অ্যাপার্টমেন্টগুলোর দাম ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নিলাম ক্রয়কারীদের সাথে যোগসাজশে এক কোটি ২০ লাখ টাকায় বিক্রি করেছে। এক্ষেত্রে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে।

এ মামলা খারিজের জন্যে অকশন ক্রয়কারী গুলশানের সি ব্লকের ২৫ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেন খান নিম্ন আদালতে আবেদন করেন। নিম্ন আদালত তার আবেদন গত বছরের ২৪ জানুয়ারি খারিজ করে দেন। আদালত বলেন, যেহেতু নিলাম বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে সেহেতু এর বিচার চলবে। নিম্ন আদালতের খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে নিলাম ক্রয়কারী মোহাম্মদ হোসেন খান হাইকোর্টে সিভিল রিভিশন ৩৬৪/২০১৩ দায়ের করেন। এ মামলার প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেন।

আইনজীবীরা জানান, মাস খানেক আগে ওই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শুরু হয় বিচারপতি শরিফ উদ্দিন চাকলাদার ও বিচারপতি একেএম সাহিদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে। সোমবার পরবর্তী শুনানির জন্য কার্যতালিকার ২২ নম্বর আইটেম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিলো। নিলাম ক্রয়কারী মোহাম্মদ হোসেন খানের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন আবুল খায়ের আজিম মান্না এবং ঋণগ্রহীতাদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মো. আসাদুজ্জামান। পরে আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান হাইকোর্টের এ আদেশের বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমকে নিশ্চিত করলেও কোন মন্ত্রী, কখন বা কেন ফোন করেছেন, তা তিনি জানাননি। এমনকি হাইকোর্ট বেঞ্চও ওই মন্ত্রীর নাম উল্লেখ করেননি।

এদিকে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ মন্ত্রীর নাম উল্লেখ না করলেও ঘটনার পর সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে ওই মন্ত্রীর নামও ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি নিলাম ক্রয়কারী পক্ষই মন্ত্রীকে দিয়ে ফোন করিয়েছেন বলেও কেউ কেউ জানান।