ভূমিকম্পে দেশের চার অঞ্চল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ : উত্পত্তিস্থল হবে সিলেট!

মোকাবেলা প্রস্তুতির জন্য তৈরি হয়েছে মানচিত্র : ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে ৩ লাখ ২৬ হাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ

 

স্টাফ রিপোর্টার: দেশে ভূমিকম্পের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চল। অতীতে যেসব বিধ্বংসী ভূমিকম্প বাংলাদেশকে আলোড়িত করেছে, সেগুলোর উত্পত্তিস্থল ছিলো দেশের সীমান্তবর্তী প্লেট বাউন্ডারিচ্যুতি এবং দেশের ভেতরের ডাউকি ও মধুপুর চ্যুতি। এ চ্যুতিগুলোই চারটি অঞ্চলের জন্য বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। ২০১৯ সালের দিকে সিলেট সীমান্তে সক্রিয় ডাউকি ফল্টের কাছাকাছি উত্সস্থল থেকে ভূমিকম্প হতে পারে- এ শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামালের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি ‘বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি’ বিষয়ে এক গবেষণা-প্রবন্ধে তিনি ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করেছেন। গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সহায়তা করে।

গত ২৫ ও ২৬ এপ্রিল নেপালে সংঘটিত ৭ দশমিক ৯ ও ৬ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের উত্সস্থল স্যামজুং ও কোদারি এলাকা থেকে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূ-পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের দূরত্ব ছিলো যথাক্রমে ৭৪৫ কিলোমিটার ও ৮১২ কি.মি। ওই মাসেই আরো কয়েকদফা ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে নেপাল ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলো। ২৫ ও ২৬ এপ্রিলের ভূমিকম্পে ঢাকা শহরের আটটি ভবনসহ মোট ১৮টি ভবন হেলে পড়ে। চলতি দশকেই সিলেট অঞ্চলে মাঝারি মাত্রার (রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রা পর্যন্ত) ভূমিকম্প হলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও সচেতনতা বৃদ্ধি কমিটির সভায় জানানো হয়, ঢাকাসহ কয়েকটি বড় শহরে ৩ লাখ ২৬ হাজার ভবন রয়েছে। একটি এরিয়াল জরিপ (স্যাটেলাইট জরিপ) ও পর্যবেক্ষণে ৭২ হাজার ভবন ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। বড় ধরনের ভূমিকম্প অনুভূত হলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনসমূহ চিহ্নিত করে সেগুলো ভেঙে ফেলা প্রয়োজন। ভেঙে ফেলা সম্ভব না হলে সেগুলো চিহ্নিত করে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয়া দরকার। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজউক, সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যৌথভাবে সভা করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে।

দেশের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) জাতীয় বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য বিপজ্জনক হচ্ছে প্লেট বাউন্ডারি ফল্ট-১। মধুপুর চ্যুতিটি ঢাকার জন্য যতটা বিপজ্জনক, তার চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক ময়মনসিংহ অঞ্চলের জন্য। ওই অঞ্চলের জন্য প্লেট বাউন্ডারি ফল্ট-২ (পিবিএফ-২)-এর ভূমিকম্প বিপজ্জনক। সিলেট অঞ্চলের জন্য বিপজ্জনক হচ্ছে ডাউকি চ্যুতি ও প্লেট বাউন্ডারি ফল্ট-৩। রংপুর অঞ্চলের জন্যও ওই দুইটি চ্যুতি বিপজ্জনক। এছাড়া সৈয়দপুর এলাকায়ও চ্যুতি রয়েছে। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে সৈয়দপুরে রেললাইন বাঁকা হয়ে গিয়েছিলো।

গবেষণায় বলা হয়, এ চ্যুতিগুলো ওই চার অঞ্চলের সন্নিহিত হওয়ায় এসব অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি। তবে ওই চ্যুতিগুলো থেকে নিকট ভবিষ্যতে বিধ্বংসী কোনো ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে কম হলেও নিশ্চিন্ত থাকা যায় না। চ্যুতিগুলোতে সৃষ্ট দুটি বিধ্বংসী ভূমিকম্পের মধ্যবর্তী যেকোনো সময়ে মাঝারি মাত্রার (রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রা পর্যন্ত) ভূমিকম্প হতে পারে। এ মাত্রার ভূমিকম্পও চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের জন্য বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির কারণ হবে।

অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল জানান, পৃথিবীতে গত ১৫ বছরে যে কটি বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়েছে, তার মধ্যে ২০০১ সালে ভারতে, ২০০৫ সালে পাকিস্তানে, ২০০৮ সালে চীনের সিচুয়ানে, ২০১০ সালে হাইতিতে ও ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমার ভূমিকম্প বিশ্বকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল। তিনি বলেন, এসব ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছিল অপরিকল্পিত নগরায়ন, নির্মাণ আইন না মেনে নিম্নমানের বাড়িঘর ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণে। একই কারণে ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতেও ভূমিকম্পে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। ঝুঁকি কমাতে শহরগুলোতে এখনই পরিকল্পিতভাবে ভূমিকম্প সহিষ্ণু-প্রতিরোধী বাড়িঘর ও অবকাঠামো নির্মাণ করা উচিত। গবেষণায় চিহ্নিত চারটি অঞ্চলের পাশাপাশি আরো কয়েকটি এলাকায়ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় আশঙ্কা করছে। মন্ত্রণালয়ের ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও সচেতনতা বৃদ্ধি কমিটির সভায় বিষয়টি আলোচিত হয়। সংশ্লিষ্টরা বলেন, সিলেট সীমান্তে সক্রিয় ডাউকি ফল্ট ও টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টের অবস্থান এবং উত্তর-পূর্ব সীমান্ত সংলগ্ন গ্রেট ইন্ডিয়ান প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল হওয়ায় বাংলাদেশ ভূমিকম্পের আশঙ্কামুক্ত নয়। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রথম পর্যায়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট সিটি করপোরেশনের ভূমিকম্প ঝুঁকি মানচিত্র এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ঝুঁকি মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে।

এ ছাড়া যেসব জেলা ভূমিকম্পের অতি ঝুঁকিতে রয়েছে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ সমীক্ষায় উঠে এসেছে এগুলো হলো- নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ফেনী, গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও সাতক্ষীরা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ইতোমধ্যে ভূমিকম্প পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনায় যাবতীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ ছাড়া সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচিও হাতে নেয়া হয়েছে। শিগগির সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সাথে বৈঠক করে প্রয়োজনীয় আরো কার্যক্রম শুরু করা হবে।

এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল বলেন, ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় গত ৬ মে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের সভায় ১৯ দফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ভূমিকম্প সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান ও কর্মসূচি প্রচার, সকল সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বছরে অন্তত দুবার সুবিধাজনক সময়ে ভূমিকম্পের মহড়া আয়োজন, একটি নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে সারাদেশে একযোগে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকম্পের সচেতনতা বিষয়ক কার্যক্রম গ্রহণ, বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন, সম্ভাব্য ভূমিকম্পে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের লক্ষ্যে বিদ্যুত্ ও গ্যাসের লাইন এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাকে নির্দিষ্ট মাত্রার ভূমিকম্প হলে ওই লাইনগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনসমূহে রাজউক-সিটি করপোরেশন কর্তৃক লাল রংয়ের সাইনবোর্ড লাগানো এবং সাইনবোর্ডে ‘ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং এ ভবনে বসবাস করা নিরাপদ নয়’ মর্মে উল্লেখ করা, ‘জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তহবিল’ এবং ‘জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তহবিল’ গঠনের লক্ষ্যে বরাদ্দ প্রদানের বিষয়টি আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, উপকূলীয় জেলাগুলোতে চলমান ৩৭টি উপজেলায় ৩ হাজার ২৯১টি ইউনিটের অতিরিক্ত ৩৯৩টি নতুন ইউনিট গঠন করে ৫ হাজার ৮৯৫ জন স্বেচ্ছাসেবকদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।