ভূট্টা চাষে দেশের শীর্ষে চুয়াডাঙ্গা

জহির রায়হান সোহাগ: চুয়াডাঙ্গায় বছরের পর বছর ভুট্টার আবাদ বেড়েই চলেছে। চাষিরা ভুট্টা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে। কেনো? অধিকাংশ কৃষকের অভিমত, লাভের আশায় দিন দিন এদিকে কৃষকদের আগ্রহ বেড়েছে। ভুট্টার আবাদ করে গত কয়েক বছরে তো অনেকেই অনেক কিছু করেও ফেলেছে। খরচের তুলনায় উৎপাদন বেশি, লাভের ভরসাও তাই বেশি থাকে। যদিও প্রতি বছরেই সঠিক দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়, তবুও কৃষকদের আগ্রহেই ভুট্টার আবাদ প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। তাছাড়া আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চুয়াডাঙ্গাসহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো ভূট্টা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। ভূট্টার বহুমুখী ব্যবহার এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে অধিক লাভজনক হওয়ায় ভুট্টা এখন এলাকার প্রধান অর্থকরী ফসল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে এবার চুয়াডাঙ্গায় ভুট্টার আবাদ সবচেয়ে বেশি হয়েছে। ভুট্টাচাষে চাষিরা লাভবান হওয়ায় গত বছরের চেয়ে এবছর ভুট্টা আবাদ বেড়েছে। এতো অল্প পুঁজিতে অধিক লাভবান হওয়ায় ভূট্টা আবাদের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন কৃষকরা। জেলার ভুট্টাচাষে উন্নতজাত ব্যবহার করার কারণে ভুট্টার ফলনও বেশি পাওয়া যায়। চুয়াডাঙ্গায় প্যাসিফিক-৯৮১, পাইনিয়ার ভি-৯২ ও ৯৬, এলিট, মিরাক্কেল, উত্তরণ, সানশাইন, সিপি এবং পালোয়ান এ ৯ জাতের ভুট্টা বেশি চাষ হয়। তবে সবচেয়ে বেশি চাষ হয়েছে প্যাসিফিক-৯৮১, পাইনিয়ার ভি-৯২ ও ৯৬ এবং এলিট। এ জেলায় গত বছর ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৩৭ হাজার ৩৭৫ হেক্টর। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় চাষ হয়েছিলো ১২ হাজার ৬৭৫ হেক্টর, দামুড়হুদায় ১২ হাজার ২৫০ হেক্টর, আলমডাঙ্গায় ৯ হাজার ২শ হেক্টর ও জীবননগর উপজেলায় ৩ হাজার ২৫০ হেক্টর। জেলায় এ বছর ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৪৮ হাজার ৪৩০ হেক্টর যা গত বছরের তুলনায় ১১ হাজার ৫৫ হেক্টর বেশি। গত ২০১৩-১৪ মরসুমে ৪৭ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়ে যে রেকর্ড তৈরি করে ছিলো তা এবছর ভেঙে সারাদেশের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে এসে নতুন রেকর্ড তৈরি করলো চুয়াডাঙ্গা জেলা। এ বছর চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় চাষ হয়েছিলো ১৪ হাজার ৮৯০ হেক্টর, দামুড়হুদায় ১৪ হাজার ১৮০ হেক্টর, আলমডাঙ্গায় ১২ হাজার ৮৬০ হেক্টর ও জীবননগর উপজেলায় ৬ হাজার ৫শ হেক্টর। ভুট্টা চাষে খরচ যেমন কম, অন্যদিকে ফলন এবং লাভও বেশি। এ কারণে চাষিদের মাঝে ভুট্টার চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তাছাড়া বাণিজ্যিকভাবে মৎস্য চাষ, লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগীর ফার্ম ও গরু মোটা-তাজাকরণ প্রকল্পের জন্য এখানেই ভুট্টার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
এছাড়া অনেক চিকিৎসকের মতে, ভূট্টায় ভিটামিন এ রয়েছে প্রচুর পরিমাণ। ভূট্টা থেকে তেল করা যায়। কোলস্টেরল ফ্রি হওয়ায় এই তেল স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। বিশেষ করে হার্টের জন্য। ধান ও গমের তুলনায় ভুট্টার পুষ্টিমান বেশি। এতে প্রায় ১১% আমিষ জাতীয় উপাদান রয়েছে। আমিষে প্রয়োজনীয় এ্যামিনো এসিড, ট্রিপটোফ্যান ও লাইসিন অধিক পরিমানে আছে। এছাড়া হলদে রংয়ের ভুট্টা দানায় প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ৯০ মিলিগ্রাম ক্যারোটিন বা ভিটামিন ‌‌‌‘‌এ’ থাকে। ভুট্টার দানা মানুষের খাদ্য হিসেবে এবং ভুট্টার গাছ ও সবুজ পাতা উন্নত মানের গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবেও এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছ। শুধু পশু, মুরগির খামার ও মাছের চাহিদা মেটানোর জন্যই বছরে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার টন ভুট্টা দানা প্রয়োজন। বাংলাদেশে ভুট্টার জমি দ্রুত বাড়ছে।
দামুড়হুদার নতিপোতা গ্রামের ভুট্টা চাষি মতিয়ার রহমান জানান, এ বছর তিনি ৮ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন। ধানের আবাদের চেয়ে ভূট্টার আবাদ অনেক লাভজনক এবং তার দেখাদেখি এখন ওই এলাকার অনেক চাষীই ভূট্টা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বিঘা প্রতি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হলেও ৩৫ থেকে ৪০ মণ পর্যন্ত ভুট্টা উৎপাদন সম্ভব। এছাড়া এ অঞ্চলে পাইনিয়ার ভি-৯২ জাতের ভুট্টা বেশি চাষ হয়েছে। ভুট্টা চাষের পর ভুট্টার শুকনো গাছ ও ভুট্টা মাড়াইয়ের পর তা জ্বালানি হিসেবে বাজারে বিক্রি করে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা যায়।
কালিয়াবকরী গ্রামের চাষি মানিক আলী জানান, গত বছর ভুট্টা বিক্র করে লাভের মুখ দেখা গেছে। গত বছর ভুট্টার দাম ছিলো মণ প্রতি ৭শ টাকা। তবে এবার এলাকায় ভুট্টা বেশি চাষ হওয়ায় দাম নিয়ে চাষিরা শঙ্কায় রয়েছেন। তাছাড়া এ দেশে চাহিদার তুলনায় ভুট্টার উৎপাদন কম। চাহিদা পূরণে সরকারকে অন্য দেশ থেকে ভুট্টা আমদানি করতে হয়। ফলে দেশের চাষিরা ভাল দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ নির্মল কুমার দে জানান, এবার দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে চুয়াডাঙ্গা ভুট্টাচাষে শীর্ষ অবস্থানে এসে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এটি চুয়াডাঙ্গা জেলাবাসীর জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে প্রতিবারের মত এবারও ভুট্টার ভাল ফলন পাওয়া যাবে। স্থানীয় চাষিরা অর্থনৈতিকভাবে বেশি লাভের কথা চিন্তা করেই ভূট্টাচাষে আগ্রহী হয়েছে। উন্নতমানের বীজ সরবরাহ করায় এবং উৎপাদিত ফসলের ভাল দাম পাওয়ায় চাষিরা ভূট্টাচাষে উৎসাহিত হচ্ছে। এছাড়া উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চাষিদের চাষে আগ্রহ বৃদ্ধি ও দক্ষ করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলে জানান তিনি।