ভুল আর ভাগ্য বিড়ম্বনায় আক্রান্ত পঙ্গু জামেলার জীবনচিত্র

ছেলে ডাক্তার হলেও মাকে করতে হয় ভিক্ষে

 

আলম আশরাফ/সাইফ জাহান: বেটা ও বেটার বউ দুজনই ডাক্তার। অথচ পঙ্গু মা জামেলা খাতুনকে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরে ক্রেসে ভর দিয়ে ভিক্ষে করে আহার জোগাতে হয়। কেমন পুত্র? কেমন পুত্রবধূ? যে মাকে খোঁজ রাখে না? নাকি মায়ের কারণেই মায়ের ওপর অভিমান করে ঘুরিয়ে রেখেছে মুখ?

DSC09492

জামেলা খাতুন চুয়াডাঙ্গা বেলগাছি মুসলিমপাড়ার এক ঝুঁপড়িতে মাসে মাসে দুশ টাকা ভাড়া দিয়ে বসবাস করেন। গতকাল সোমবার সরাদিন তিনি ক্রেসে ভর দিয়ে মেহেরপুর শহরের অলিগলি ঘুরে সন্ধ্যার পর ভাড়ায় নেয়া জীর্ণকুঠিরে ফেরেন। এ সময় তার সাথে ছেলে, ছেলের বউ, মেয়ে এবং ভিক্ষাবৃত্তিতে নামার বিষয়ে কথা হয়। দেশে ভিক্ষাবৃত্তির আইনগত বৈধতা নেই। এটা ক’জন ভিক্ষুক জানেন? জামেলা খাতুন বললেন, সাধে কি আর কেউ অন্যের কাছে দয়া নেয়ার জন্য হাত পাতে? আমিও তো শখ করে ভিক্ষা করতে রাস্তায় নামিনি! কিছু ভুল আর দুর্ভাগ্যের কারণেই ভিক্ষা করতে হচ্ছে এখন আমাকে। তবুও খুশি, ছেলেমেয়েদের তো আর আমার মতো করে খেয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে না! ওরা ভালো শুনেই খুশি। ওরা সুখে আছে ভেবেই রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি। পেটের তাগিদেই সকালে ভিক্ষের ঝুলিটা হাতে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি।

কেন ভাগ্যের নির্মম পরিহাস? কি সেই ভুল? এসব প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ৫৫ বছর বয়সী জামেলা খাতুন এক নাগাড়ে বললেন তার জীবনের ইতিবৃত্ত। পিতার বাড়ি নঁওগার মাধবপুর। সেখানেই মামাতো ভাই আব্দুস সামাদের সাথে বিয়ে হয়। সংসারে আসে এক ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলের নাম রাখা হয় হাসান। আর মেয়ে সুখজান সূর্য। হাসানের বয়স যখন ৭ বছর তখন মারা গেলো স্বামী সামাদ। অথৈ সাগরে পড়লাম। সংসারে সহযোগিতার হাত বাড়ালো মাধবপুরের এক জামাই হাবিবুর রহমান হবি। তার বাড়ি ময়মানসিংহের কুমারপুর ঈশ্বরগঞ্জে। হবির সাথে ঘর বাঁধলে সুখ হবে ভেবে ওর হাত ধরে পথে বের হলাম। চুয়াডাঙ্গায় এসে বসবাস শুরু করলাম। দূর-দূরান্ত থেকে এটা-ওটা এনে বিক্রি করে দুজনে সুখের সংসার চালাতে লাগলাম। এ সংসারে এলো এক মেয়ে। নাম রাখা হলো শান্তি। ওদিকে হাসান ও সূর্য ওদের মতো করে বেড়ে উঠতে লাগলো ওদের পৈত্রিক ভিটে মাধবপুরে। লেখাপড়া করতে গিয়ে হাসান একের পর এক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে অনেকের দৃষ্টি কাড়লো। পত্রিকায় খবরও ছাপা হলো। চুয়াডাঙ্গার একজন আইনজীবীও তার লেখাপড়ার জন্য মাসে মাসে টাকা দিতে শুরু করলেন। আমিও যতোটা পেরেছি দিয়েছি। হাসান এখন ডাক্তার। ওর বউও ডাক্তার। বেটা বেটার বউ দুজনই ডাক্তার, এখন ওরা ভালোই আছে। মেয়ে সূর্যরও বিয়ে হয়েছে। ভালো আছে সেও। আর এদিকে আমার দ্বিতীয় স্বামী হবি মারা গেলো। মেয়ে শান্তিকে চুয়াডাঙ্গারই সাতগাড়িতে বিয়ে দিলাম। স্বামীর মৃত্যুর পর নিজেকে ট্রেনে ছুটে এটা ওটা আনার কাজ করতে হতো। ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে পায়ের আঙুলটা কেটে গেলো। সেখানেই ধরলো পঁচন। পরে পাটাই কেটে বাদ দিতে হয়েছে। এখন আমি পঙ্গু ভিক্ষুক। ভিক্ষা করেই দু বেলা দু মুঠো খাবার জোটাচ্ছি। আর কাছে এবং দূরে থাকা সন্তানদের জন্য দু হাত তুলে দোয়া করছি, ওরা আমার খোঁজ রাখুক আর না রাখুক, ভালো থাকুক।

জামেলা খাতুন তার জীবনছবি মেলে ধরতে গিয়ে মাঝে মাঝে অভিমানি হাসি লুকোলেও আড়াল করতে পারেননি অশ্রু। চেয়ারে বসে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোণা মুছার সময়ও বললেন, বিশ্বাস করুন, ওরা ভালো আছে বলেই আমি শান্তিতে ঘুমোতে পারি। যে ডাল ধরলাম, সেই ডালই ভাঙলো। আমার জীবনটাই এখন আমার কাছে বোঝা। এ বোঝা বওয়া কবে শেষ হবে কে জানে!