ভালোবাসা দিবসের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ঝিনাইদহের ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা

শাহনেওয়াজ খান সুমন: ফুল ছাড়া কি প্রিয় মানুষকে হৃদয়ের জমে থাকা ভালোবাসার কথা বলা যায়। হৃদয়ে জমে থাকা সেই ভালোবাসা ফুল ছাড়া যেন অসম্পন্নই থেকে যায়। প্রিয় মানুষটিকে মূল্যবান কোনো উপহার দিতে পারুক আর নাই পারুক ছোট্ট একটি ফুল তুলে দিয়ে প্রকাশ করতে পারে হৃদয়ের গভীর ভালোবাসা। আজ পয়লা বসন্ত আর একদিন পরেই বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। তাইতো ভালোবাসা প্রকাশের মহামূল্যবান ফুলটি দেশের অগণিত তরুণ-তরুণীসহ সকল বয়সের মানুষের হাতে তুলে দিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন ঝিনাইদহের ফুলকন্যারা। প্রতিবছর বসন্ত বরণ, ভালোবাসা দিবস, বাংলা ও ইংরেজি নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মতো দিনগুলোতে ফুলের অতিরিক্ত চাহিদা থাকে। আর এ চাহিদার সিংহভাগ যোগান দিয়ে থাকেন এ এলাকার ফুলচাষিরা।

ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় মাঠের পর মাঠে চাষ হয়েছে গাঁদা, রজনীগন্ধা, গোলাপ ও গ্লাডিয়াসসহ নানা জাতের ফুল। এসব ফুল ক্ষেত থেকে সংগ্রহ ও মালা গাঁথা থেকে শুরু করে বিক্রি করা পর্যন্ত এ এলাকার মেয়েরা করে থাকেন। ফলে পুরুষের পাশাপাশি মেয়েদেরও কর্মসংস্থান হচ্ছে। এ এলাকার উৎপাদিত ফুল প্রতিদিন দূরপাল্লার পরিবহনে চলে যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে। জাতীয় ও বিশেষ দিনগুলো ছাড়াও সারাবছর এ অঞ্চলের উৎপাদিত ফুল সারাদেশের চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখে।

কথা হয় জেলার ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার ফুলনগরী বলে খ্যাত বড়ঘিঘাটি গ্রামের ফুলকন্যা নাজমা, নুরজাহান, সরস্বতী ও আয়েশা বেগমের সাথে। তারা জানান, বছরের বারো মাসই ফুল তোলার কাজ করেন তারা। কিন্তু বিশেষ বিশেষ দিন সামনে রেখে কাজ বেশি করতে হয়। আয় উপার্জনও বেশি হয়। তারা জানান, এখন ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে সকাল বিকেল কাজ করতে হচ্ছে। ব্যপারীরা ফুল নিতে ফুল মালিকের বাড়ি বসে থাকেন। যে কারণে সব কিছু রেখে সারাদিন ফুল তুলছেন তারা।

তারা আরও জানান, প্রতি ঝোপা ফুল তুলে গেঁথে দিলে ফুল মালিক ১০ টাকা করে দেন। প্রতিদিন তারা ১২ থেকে ১৮ ঝোপা ফুল তুলতে পারে। অনেকে আবার স্থানীয় এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে একটি বাড়ির কাজ ও গৃহপালিত পশু কেনে। এরপর ফুলের কাজ করে কিস্তির টাকা পরিশোধ করি। এভাবেই এ এলাকার প্রায় প্রতি বাড়ির নারীরা এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত। যে কারণে এই এলাকার মানুষ দিনে দিনে এখন বেশ সচ্ছল হয়ে উঠছেন।

ঝিনাইদহ কৃষি অফিসের উপপরিচালক জয়নুল আবেদীন জানান, এ বছর জেলায় প্রায় ৫শ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে গ্লাডিয়াস, রজনীগন্ধা গোলাপ, গাঁদাসহ নানা জাতের ফুল। উৎপাদন ব্যয় কম, আবার লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকরা ফুলচাষে আগ্রহী হচ্ছেন। জেলার গান্না, বালিয়াডাঙ্গা, তিল্লা, সিমলা, রোকনপুর, গোবরডাঙ্গা, পাতবিলা, পাইকপাড়া, তেলকূপ, গুটিয়ানী, কামালহাট, বিনোদপুর, দৌলতপুর, রাড়িপাড়া, মঙ্গলপৈতা, মনোহরপুর,  ষাটবাড়িয়া, বেথুলী, রাখালগাছি, রঘুনাথপুরসহ জেলার বিভিন্ন গ্রামের মাঠে ফুলচাষ করা হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি গাঁদা ফুলচাষ হয় কালীগঞ্জে বালিয়াডাঙ্গা এলাকায়। এ কারণে সবাই এখন এ এলাকাকে ফুলনগরী বলেই চেনে।

সরেজমিনে বালিয়াডাঙ্গা বাজার ও কালীগঞ্জের মেন বাসস্ট্যান্ডে দেখা যায়, দুপুর থেকে শ শ কৃষক তাদের উৎপাদিত ফুল ভ্যান, স্কুটার ও ইঞ্জিনচালিত বিভিন্ন পরিবহনযোগে নিয়ে আসেন। বেলা গড়ানোর সাথে সাথে বালিয়াডাঙ্গা বাজার ও কালীগঞ্জ মেন বাসস্ট্যাণ্ড ভরে যায় লাল, শাদা আর হলুদ ফুলে ফুলে।

সারাদেশের আড়তগুলোতে ফুল পাঠাতে আসা একাধিক ফুলচাষির সাথে আলাপ করে জানা গেছে, সারাবছরই তারা ফুল বিক্রি করে থাকেন। তবে প্রতিবছর বাংলা ও ইংরেজি নববর্ষের দিন, স্বাধীনতা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ভালোবাসা দিবস প্রভৃতি দিনগুলোতে ফুলের অতিরিক্ত চাহিদা থাকে। এ সময় দামও থাকে ভালো। ফুলচাষিরা নিজেরা না এসে সারাবছর তাদের ক্ষেতের ফুল চুক্তি মোতাবেক ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বড় বড় শহরের ফুলের আড়তে পাঠিয়ে দেন। এ সকল স্থানের আড়তদারেরা বিক্রির পর তাদের কমিশন রেখে বাকি টাকা পাঠিয়ে দেন। ফলে ফুল চাষিদের টাকা খরচ করে ফুল বিক্রির জন্য কোথাও যাওয়া লাগে না। তারা মোবাইল বা ফোনালাপের মাধ্যমে বাজার দর ঠিকঠাক করে ফুল পাঠিয়ে থাকেন বলেও জানান কৃষকরা।

দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখলেও দ্রুত পঁচনশীল ফুল সংরক্ষণের জন্য নেই কোনো ব্যবস্থা। ফলে যখন বাজারে যোগান বৃদ্ধির কারণে হঠাৎ দাম কমে যায় তখন লোকসানে বিক্রি করা ছাড়া উপায় থাকে না ফুলচাষিদের। ফলে কৃষকেরা বঞ্চিত হন ন্যায্যমূল্য থেকে।

বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের ফুলচাষি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক জানান, ১৯৯১ সালে এ এলাকায় সর্বপ্রথম ফুল চাষ করেন বালিয়াডাঙ্গার ছব্দুল শেখ। তিনি ওই বছর মাত্র ১৭ শতক জমিতে ফুলচাষ করে স্থানীয় বিয়ে, সামাজিক অনুষ্ঠান ও জাতীয় দিবসগুলোতে ক্ষেত থেকেই বিক্রি করে প্রায় ৩৪ হাজার টাকা লাভ করেছিলেন। এরপর থেকে এ চাষ বিস্তার লাভ করতে থাকে। ধান-পাট-সবজি প্রভৃতি ফসলের চাষ করে উৎপাদন ব্যয় বাদ দিলে খুব বেশি একটা লাভ থাকে না। কিন্তু ফুলচাষ করলে আবহাওয়া যদি অনুকূলে থাকে তাহলে যাবতীয় খরচ বাদে প্রতি বিঘায় ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব। ফলে দিন যত যাচ্ছে এ অঞ্চলে বৃদ্ধি পাচ্ছে ফুলচাষ।

স্থানীয় ফুলচাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান জানান, এলাকার কৃষকরা কষ্ট করে ফুল উৎপাদন করলেও প্রায়ই তারা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। মধ্যস্বত্বভোগীরা কম দামে কিনে অনেক লাভবান হন। কিন্তু ফুল সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে কৃষকরা কম দামে তাদের হাতে ফুল তুলে দেন।