বড়হাটের আস্তানায় মুহুর্মুহু গুলি বিস্ফোরণ : পুলিশ আহত

অপারেশনটি জটিল হওয়ায় আজ সকাল পর্যন্ত স্থগিত : মনিরুল ইসলাম

স্টাফ রিপোর্টার: মৌলভীবাজারে দ্বিতীয় জঙ্গি আস্তানা শহরের বড়হাটের একটি বাড়িতে গতকাল শুক্রবার দিনভর সোয়াটের অভিযানের সময় মুহুর্মুহু গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে। এ সময় আহত হয়েছেন পুলিশের একজন সদস্য। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, বড়হাটের জঙ্গি আস্তানায় বোমা বিশেষজ্ঞ রয়েছে, এছাড়া বাড়িতে রয়েছে প্রচুর বিস্ফোরক। তিনি বলেন, অভিযান চলমান রয়েছে। তবে অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় আগামীকাল (আজ) শনিবার সকাল পর্যন্ত অভিযান স্থগিত করা হয়েছে। সকালে আবহাওয়া ভালো থাকা সাপেক্ষে পুনরায় অভিযান শুরু করা হবে। এদিকে সন্ধ্যায় অভিযান স্থগিতের পরও রাত আটটার দিকে ওই বাড়ি থেকে পর পর আরো তিনটি বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে। এসময় সোয়াট টিমের সদস্যরা বাড়িটি লক্ষ্য করে ২০/২৫ রাউন্ড গুলি চালান। অন্যদিকে কুমিল্লার কোটবাড়ীর জঙ্গি আস্তানায় কাউকে পাওয়া যায়নি তবে বোমা পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামের রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুর রহমান জানিয়েছেন, এই আস্তানায় দুই জঙ্গি ছিল। তাদের একজন বুধবার সকাল ১০টার আগেই চলে গেছে, অন্যজন বিকালে হয়তো পালিয়ে গেছে। যে দুই জঙ্গি ছিলো, তার মধ্যে একজনের নাম আনাস ওরফে আনিস, অন্যজনের নাম রনি। তবে ভেতরে বিস্ফোরক রয়েছে জানিয়ে ডিআইজি বলেন, সেগুলো নিষ্ক্রিয় করার জন্যে অভিযান শনিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে।

বড়হাটে অপারেশন ম্যাক্সিমাস: মৌলভীবাজারের বড়হাটে অপারেশনের নাম দেয়া হয়েছে অপারেশন ম্যাক্সিমাস। গতকাল শুক্রবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে সোয়াটের অভিযান শুরু হওয়ার পর বেশ কিছু সময় থেমে থেমে গুলি চলছিল। এর মধ্যে বেলা ১১টার দিকে একটি বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায় এবং তিন তলা ওই বাড়ি থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। এরপর বেলা সোয়া ১২টা থেকে প্রায় আধা ঘণ্টা টানা গুলির আওয়াজ আসতে থাকে ওই বাড়ির দিক থেকে। ওই সময়ের মধ্যে তিন দফা বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে। এর পরপরই এক পুলিশ সদস্যকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেখা যায়। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম’র (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম ওই জঙ্গি আস্তানা এলাকা পরিদর্শনে যান। অভিযান সম্পর্কে তিনি বলেন, অপারেশনটি শুরু হয়েছে সকাল পৌনে ১০টার দিকে। এটি একটি জটিল অপারেশন। এজন্য সময় লাগতে পারে। তিনি বলেন, ভবনের ভিতরে আবার অনেকগুলো কামরা। আমাদের কাছে খবর রয়েছে ভেতরে প্রচুর পরিমাণ বিস্ফোরক এবং একজন বিস্ফোরক এক্সপার্ট আছে। সেজন্য অপারেশনটি সফল করতে সময় লাগতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে। কোন ধরনের আপডেট থাকলে আপনাদের জানানো হবে। মনিরুল বলেন, আপনারা এখান থেকে শুনেছেন যে জঙ্গিরা ভেতর থেকে কিছু বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। আমাদের সোয়াট দলটি যখনই ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেছে, তখনই জঙ্গিরা ভেতর থেকে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। বাড়িটি এখনও ঘিরে রাখা হয়েছে। এই অভিযানে তারা ড্রোন ব্যবহার করে দেখেছেন, ডুপ্লেক্স আদলের বাড়িটির ভেতরে প্রচুর বিস্ফোরক ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে। একাধিক জঙ্গির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলেও তিনি জানান। অভিযানে অংশ নেয়া সিটিটিসি ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, তারা ধারণা করছেন এই আস্তানায় আফগান ফেরত একজন জঙ্গি আছে। সে বোমা তৈরিতে দক্ষ বলেও তথ্য রয়েছে পুলিশের কাছে।

পুলিশ সদস্য আহত: সকাল সাড়ে ১১টার দিকে জঙ্গি আস্তানায় প্রবেশের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাড়ির পাশের গাছ কাটতে শুরু করে। দুপুর ১টার দিকে সেখানে এক পুলিশ সদস্য আহত হন। আহত পুলিশ সদস্যের নাম কয়সর। আহত কয়সর মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে চিকিত্সাধীন রয়েছেন। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহজালাল বলেন, তিনি জেলা পুলিশের সদস্য। ধারণা করা হচ্ছে অভিযান চলাকালীন গুলির কার্তুজ লেগে তিনি আহত হয়েছেন।

প্রচণ্ড গোলাগুলি: বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে ৫টার দিকে বাড়িটি ঘিরে আবারও প্রচণ্ড গোলাগুলি ও বোমা বিস্ফোরিত হয়। জঙ্গি আস্তানার ওপরে ধোয়া উড়তে দেখা যায়। অভিযানে সোয়াট টিম প্রচুর পরিমাণে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। এ সময় বিভিন্ন আশপাশের বাসা-বাড়ির লোকজন দৌঁড়-ঝাপ শুরু করেন। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে অভিযানের কারণে মৌলভীবাজার শহরের দোকানপাটও বন্ধ রয়েছে। শহরে জনসাধারণের চলাচলও সীমিত। কৌতুহলী জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে জড়ো হলে পুলিশ তাদের তাড়া দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকেই কয়েক ধাপে বড়হাটে প্রচণ্ড গোলাগুলি ও বোমা বিস্ফোরিত হচ্ছে। মৌলভীবাজারের ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও পৌর এলাকার ৬ নং ওয়ার্ড দিয়ে সকল ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে।

      কুমিল্লায় অপারেশন স্ট্রাইক আউট: গতকাল সকাল থেকে জেলার কোটবাড়িস্থ জঙ্গি আস্তানায় অপারেশন স্ট্রাইক আউট নামে শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান শুরু করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নগরীর সদর দক্ষিণ মডেল থানার বাগমারাসংলগ্ন কোটবাড়ি এলাকার গন্ধমতিতে সন্দেহভাজন একটি বাড়ি ঘিরে অভিযান চলাকালে মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কাছে দেওয়া এক জঙ্গির তথ্য মতে গত বুধবার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য ওই বাড়িটি ঘেরাও করে দরজায় বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেয়। সেখানে একটি কক্ষে জঙ্গিরা বোমা ও বিস্ফোরক নিয়ে অবস্থান করছে বলে পুলিশ ধারণা করেছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে ভোটকেন্দ্রসংলগ্ন ওই বাড়িটিতে অভিযান না চালিয়ে পরদিন (গতকাল) শুক্রবার অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গতকাল সকাল ৮টা থেকে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে অপারেশন স্ট্রাইক আউটের প্রস্তুতি শুরু করা হয়।

জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রুপালী মণ্ডল অভিযান পরিচালনার স্বার্থে সকাল থেকে ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে জনগণ ও যানবাহন চলাচলের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। মাইকযোগে এলাকাবাসীকে সতর্ক অবস্থানে থাকার জন্য বলা হয়।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট সূত্র জানায়, গন্ধমতি গ্রামের একটি বড় কবরস্থানের পশ্চিম পাশে নির্মাণাধীন তৃতীয় তলা বিশিষ্ট বাড়িটির অবস্থান। বাড়িটির মালিক আহাম্মদ আলী। নিচতলার এক পাশে এক বিজিবি সদস্য পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকে। দ্বিতীয় তলায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মেস করে থাকেন। তৃতীয় তলার নির্মাণকাজ এখনো কাজ শেষ হয়নি। অভিযান সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বাড়িটির দোতলায় তালাবদ্ধ একটি কক্ষে সুইসাইডাল ভেস্ট ও কিছু বিস্ফোরক দ্রব্য পাওয়া যায়। তবে সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি।

আস্তানায় বোমা মিলেছে, দুই জঙ্গি পালিয়েছে: গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় কুমিল্লা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক প্রেসব্রিফিংয়ে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, আস্তানায় দুই জঙ্গি ছিলো। চট্টগ্রামের মীরেশ্বরাইয়ে অভিযানকালে আটক জঙ্গির দেয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, নোয়াখালীর জঙ্গি আনাছ ওরফে আনিছ (২০) ও রাজশাহীর নব্য জেএমবির সদস্য রণি (২২) মীরেশ্বরাই থেকে পালিয়ে কুমিল্লার গন্ধমতির ওই বাসা ভাড়া নিয়ে অবস্থান করছে। সাথে করে তারা ট্রলি ব্যাগ ভর্তি বোমা, হ্যান্ড গ্রেনেড ও সুইসাইডাল বেল্ট নিয়ে এসেছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার বাসাটি আমরা খুঁজে বের করি। বাড়ির মালিক আমাদের জানিয়েছিলেন, জঙ্গিদের মধ্যে একজন বের হয়ে গেছে, আরেকজন বাসায় ঘুমিয়ে আছে। বাড়ির মালিকের তথ্য অনুযায়ী আমরা বাসার কক্ষটি খুঁজে পেয়ে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে বাড়িটি ঘেরাও করে রাখি। শুক্রবার অভিযান চালানোর একপর্যায়ে বোম ডিসপোজাল টিম কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে কয়েকটি শক্তিশালী বোমার সন্ধান পায়, তবে কাউকে পাওয়া যায়নি। তিনি আরও জানান, ওইসব বোমা ভারী ও শক্তিশালী হওয়ায় এবং কক্ষটি ঘুটঘুটে অন্ধকার এবং টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকায় বোমা নিষ্ক্রিয় করা যায়নি। শনিবার ঘটনাস্থলেই এসব বোমা নিষ্ক্রিয় করা হবে। এসব বোমা নিষ্ক্রিয় না করা পর্যন্ত ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা বলবত্ থাকবে। তিনি আরও জানান, বাড়িটি শনাক্ত করতে সময় লাগায় জঙ্গিরা এরইমধ্যে বাড়ি থেকে সরে যাওয়ার কারণে তাদের আটক করা যায়নি। তবে মীরেশ্বরাই থেকে আটক জঙ্গির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ব্যাগ ও বোমা শনাক্ত করা হয়েছে।

নাসিরপুরে নিহতদের ময়নাতদন্ত, জন শিশু: এদিকে মৌলভীবাজারের নাসিরপুর জঙ্গি আস্তানায় নিহতের মধ্যে ২ জন নারী, একজন পুরুষ ও ৪ জন শিশু রয়েছে। গতকাল এদের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। তবে তাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।  ময়নাতদন্তকারী চিকিত্সক মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক পার্থ সারথি দত্ত কানুনগো জানিয়েছেন, নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানায় পাওয়া ৭টি লাশে পচন ধরেছিল। এই সাতজনের মৃত্যু হয়েছে ময়নাতদন্তের ৩০-৩৫ ঘণ্টা আগে। এ কারণেই লাশগুলোতে পচন ধরে। তিনি  আরো বলেন, লাশগুলো সব ছিন্নভিন্ন ছিল। তাদের বুক থেকে নিচের অংশ পাওয়া যায়নি। সবার শরীরের সঙ্গে প্যাঁচানো তার মিলেছে। বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট পা দেখে বোঝা যাচ্ছে সেগুলো শিশুদের। তারা সবাই আত্মঘাতী হয়েছে।

ময়নাতদন্তকারী চিকিত্সক দলের সদস্য ডা. পলাশ রায় বলেন, নিহত পুরুষের বয়স ৩৫ এবং নিহত ২ নারীর বয়স আনুমানিক একজনের ৩০ ও অন্যজনের ২৫ বছর হতে পারে। নিহত শিশুদের একজনের বয়স দুই বছর, একজনের সাত বছর ও একজনের ১২ বছর হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদের মধ্যে তিনজন মেয়ে বলে শনাক্ত করা গেছে। আরেক শিশুর বয়স ২ থেকে ৩ মাস। এই মরদেহটির কেবল মুখমন্ডল পাওয়া গেছে। ফলে ছেলে না মেয়ে তা নিশ্চিত হওয়া যায় নি। ডা. পলাশ আরো বলেন, ‘সুইসাইডাল ভেস্ট’ বিস্ফোরণ ঘটিয়েই তারা আত্মহনন করে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ নিহতদের কারো শরীরেই কোনো গুলির চিহ্ন নেই। নিহতদের ডিএনএ’র নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।