ব্যর্থতা মানতে রাজি নন খালেদা

স্টাফ রিপোর্টার: আন্দোলনে ব্যর্থতা মানতে রাজি নন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলছেন আন্দোলনে সাফল্য অনেক। এক. নির্বাচন এক তামাশায় পরিণত হয়েছে। দুই. দেশে-বিদেশে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তিন. গ্রামের মানুষও এই আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। সর্বোপরি দলকে এক রাখা সম্ভব হয়েছে। পেশাজীবীসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে মতবিনিময়কালে খালেদা জিয়া এমন মনোভাবই ব্যক্ত করেছেন। দলের সাংগঠনিক দুর্বলতার দিকও কবুল করেছেন। সরকারের কৌশলের সাথে পেরে ওঠেননি- সরাসরি এমন মন্তব্য না করলেও বলছেন, আমাদের কল্পনার মধ্যে ছিলো না সরকার নিজেই সহিংসতায় নেমে পড়বে। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের আচরণে তিনি মোটেই সন্তুষ্ট নন তা বলছেন ঘনিষ্ঠজনদের। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের খেলা বিএনপিতে আগাগোড়াই ছিলো। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পর্যন্ত অবিশ্বাসের ছক থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। অবশ্য, আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন তার ভূমিকা ছিলো অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ, রহস্যে ভরা। অবশ্য দলনেত্রী তার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। বলেছেন, তারই নির্দেশ ছিল গ্রেফতার এড়ানোর জন্য। কিন্তু দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তার মতে, আলমগীর জেলের বাইরে থেকে এমন কোনো কাজ করেননি যাতে দলটি লাভবান হয়েছে। অথবা আন্দোলন বেগবান হয়েছে। বরং মোটরসাইকেলের পেছনে চড়ে আত্মগোপনে যাচ্ছেন এই চিত্র দেশবাসী দেখেছে মিডিয়ার কল্যাণে। আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন একটি ভিডিও ক্লিপ অনেককেই হতাশ করেছে।

অবশ্য মির্জা আলমগীর বন্ধু-বান্ধবদের বলছেন, আমি যাবো কোথায়? ম্যাডাম আমাকে নির্দেশ দিলেন পুলিশের কাছে ধরা না দিতে। আমি তা-ই করলাম। এখন দেখছি ভুলই করেছি। তিনি স্বীকারও করছেন, বাইরে থেকে তেমন কোনো কাজ করতে পারেননি দলের জন্য। একজন নেতাকে ভারমুক্ত না করাও কিন্তু সঠিক রাজনৈতিক কৌশল নয়। এতে অবিশ্বাস স্থায়ী রূপ নেয়। যা-ই হোক, অন্য নেতাদের অবস্থা কি? যারা জেলে ছিলেন তাদের নিয়ে কথা কম দলে। যারা বাইরে ছিলেন তারা ২৯ ডিসেম্বর কোথায় ছিলেন? কেউ তো নয়া পল্টনমুখি হননি। ঢাকার প্রবেশপথে উঁকি মেরেও দেখেননি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি করছে। নেতাদের ফোন বন্ধ ছিলো এটা ঠিক, কিন্তু সব সিম কি অকার্যকর ছিলো? কেউ কি কথা বলেননি? বলেছেন, তবে যথেষ্ট সতর্কতার সাথে। কোনো নেতাই দলের কর্মীদেরকে মাঠে নামতে বলেননি। বরং বলেছেন, শোনা যাচ্ছে রাস্তায় নামলে নাকি  দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যভাবেও ম্যানেজ হয়ে গিয়েছিলেন নেতারা – এ নিয়ে তো বিএনপি শিবিরেই এখন জোর আলোচনা চলছে। খালেদা জিয়ার কাছেও এসব অভিযোগ যাচ্ছে। তিনি যখন নিজ গৃহবন্দি ছিলেন তখনও নানা মাধ্যমে তার কাছে খবর পৌঁছেছিলো। অতিসমপ্রতি বেগম জিয়ার সাথে দেখা করে এসেছেন এমন একজন পেশাজীবী নেতা বলেন, দলের সাংগঠনিক অবস্থা যে এতোটা দুর্বল সে ধারণা ম্যাডামের ছিলো না। তাছাড়া অতিমাত্রায় জামায়াত-শিবির নির্ভর হওয়াটাও ঠিক হয়নি। সরকার এই সুযোগ নিয়ে অন্য খেলা খেলেছে। আন্দোলনকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য তারা এমন সব সহিংসতা করেছে যাতে পশ্চিমা দুনিয়াসহ নানা মহলে পৌঁছেছে ভিন্ন বার্তা। ফলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি, পাশাপাশি সহিংসতা বন্ধেরও তাগিদ এসেছে। আন্দোলন মাঝপথে ধাক্কা খেয়েছে। কৌশলগত ভুলের কথাও বলা হচ্ছে। ঢাকাকে আন্দোলনের বাইরে রেখে যারা কৌশল ঠিক করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তারা এখন বলছেন, কৌশল ভুল ছিল এখন হয়তো বলা যাবে। তবে শুরুতে চিন্তা ছিল সারা দেশ অচল করে শেষ কর্মসূচি হিসেবে চলো চলো ঢাকা চলো কর্মসূচি দেয়া হবে। পরবর্তীকালে এরই নাম মার্চ ফর ডেমোক্রেসি দেয়া হয়েছিল। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে যে পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল তা নেয়া হয়নি – এখন সে বিষয়টি তারা মূল্যায়ন করছেন। এটাও বলছেন, হেফাজতের ওপর দৃষ্টি রাখা দরকার ছিল। আগের দিন সরকারি প্রতিনিধি এক গুচ্ছ প্রস্তাব নিয়ে হেফাজত নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বলাবলি আছে এই বৈঠকের পরই হেফাজত আন্দোলনে শরিক না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটাও লক্ষণীয় যে হেফাজত ঢাকার মহাসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে তিন বার তারিখ পরিবর্তন করেছে। সরকার অবশ্য অনুমতি দেয়নি। অনুমতি ছাড়াই  সমাবেশ হবে এমন ঘোষণা দিয়ে হেফাজত নেতারা কেন হঠাৎ চুপসে গেলেন তা নিয়ে নানা পর্যালোচনা চলছে খোদ হেফাজতের ভেতরেই। ঢাকায় একজন হেফাজত নেতা বলেন, গোটা বিষয়টি ধোঁয়াশায় ভরা। ‘সিগন্যাল’ শব্দটি নিয়ে বিরোধী শিবিরে বহুলভাবে আলোচিত হচ্ছে। কি সে সিগন্যাল? কারও ওপর নির্ভর করে কি এমন আন্দোলনের ছক তৈরি করা হয়েছিলো? একজন বিএনপি নেতা বললেন, এটা রটনা। জনগণ আমাদের সঙ্গে ছিল এবং আছে। এরচেয়ে বড় আন্দোলন বাংলাদেশে এর আগে কখনও কি হয়েছে? বাংলাদেশ ভেঙে পড়েছিলো – এটা তো নতুন করে বলার কিছু নেই। তারপরও নির্বাচন কেন ঠেকানো যায়নি এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। আওয়ামী লীগ-ও তো ১৫ই ফেব্রুয়ারি নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি। ২০০৬-এর আন্দোলনে আওয়ামী লীগ বা তার মিত্ররা কি সফল হয়েছিলো? ওয়ান-ইলেভেন না হলে এখন যে অবস্থা হয়েছে তখনও সেরকম অবস্থাই হতো। বরং আরও  খারাপ হতে পারতো। বিএনপি নেতারা বলছেন, এটাও তো দেখতে হবে সরকারের পেছনে এমন এক শক্তি ছিল যারা সারা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে। আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে এমন সরলীকরণ খুব সহজ। সংবিধান সংশোধন করার পেছনে তো সুনির্দিষ্ট এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল। সে পরিকল্পনায় বিএনপিকে নির্বাচনী দৌড়ের বাইরে রাখাই ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। যা পুরোপুরি সফল না হলেও অনেকটাই হয়েছে।

শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে রাজি হলে নির্বাচন হতো কিনা সে প্রশ্নও তুললেন একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য। বললেন, বেগম জিয়া যে এই বিকল্প নিয়ে ভাবেননি তা নয় কিন্তু। তখন সব খবরাখবরই এসেছিল নেতিবাচক। বেগম জিয়ার কাছে খবর ছিলো, সরকার এমন খেলা খেলবে যাতে নির্বাচনই হবে না। তখন সবাই বলতো বেগম জিয়ার কারণে অন্য শাসন এসেছে। খেলাটা ছিলো সূক্ষ্ম। অঙ্ক মেলানো সহজ ছিলো না। বিএনপির এই স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, আজ হোক কাল হোক সবার অংশগ্রহণে একটি স্বচ্ছ নির্বাচন হোক- তখন দেখবেন সবাই বলবে বেগম জিয়া ভুল করেননি। ’৮৬ সালেও তো একই রকম হয়েছিলো। ’৯০ সালে সবাই বলছেন বেগম জিয়াই সঠিক ছিলেন। ’৯১-এর নির্বাচনের ফলাফলের মধ্যদিয়ে এটা প্রমাণিত হয়েছে। রাজনৈতিক পণ্ডিতরা অবশ্য বলছেন, ১৯৯০ আর ২০১৪ কি এক? বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি গড়িয়েছে।