বোর্ডভিত্তিক পৃথক প্রশ্নে এইচএসসি পরীক্ষা

স্টাফ রিপোর্টার: সারা দেশে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আগামী ২ এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা বোর্ডভিত্তিক আলাদা প্রশ্নে নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে আগের চেয়ে বেশি সেট প্রশ্ন ছাপানো, পরীক্ষা শুরুর ২০ মিনিট আগে বোর্ড থেকে কেন্দ্র সচিবকে প্রশ্ন সেট কোড জানিয়ে দেয়া, বিজি প্রেস থেকে প্রশ্ন ছাপিয়ে বিশেষ প্যাকেটে কেন্দ্রে পৌঁছানোসহ বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে বুধবার শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এসব বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠক শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, বোর্ডগুলো নিজেদের প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। পরীক্ষার আগেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হবে। তিনি আরো বলেন, এসএসসি পরীক্ষায় আধাঘণ্টা আগে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। এ অভিজ্ঞতা থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় আরেকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পরীক্ষার্থীরা রুমে ঢোকার পরে কোন সেট প্রশ্নে পরীক্ষা হবে, তা নির্ধারণ করে দেয়া হবে। বর্তমানে দুই সেট প্রশ্ন ছাপানো হলেও এইচএসসি পরীক্ষায় আরও বেশি সেট প্রশ্ন ছাপার চিন্তাভাবনা করছি।

মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, পরীক্ষার আধাঘণ্টা আগে পরীক্ষার্থী হলে প্রবেশ না করলে তাকে আর ঢুকতে দেয়া হবে না। পরীক্ষার হলে স্মার্ট মোবাইল ফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার আগের সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।

বেলা ১১টায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কক্ষে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিইসি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর সোহেল রহমান, একই বিভাগের প্রফেসর মোহাম্মদ কায়কোবাদ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. অরুণা বিশ্বাস, চৌধুরী মুফাদ আহমেদ ও জাবেদ আহমেদ।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সদ্যসমাপ্ত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সারা দেশে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়া হয়। এতে দেশের যেকোনো স্থান থেকে প্রশ্নফাঁস হলে তার প্রভাব পড়ে সারা দেশের পরীক্ষার্থীর ওপর। আগে একটি বোর্ডের প্রশ্নফাঁস হলেও অন্য বোর্ডের পরীক্ষায় প্রভাব পড়তো না। এ অভিজ্ঞতা থেকেই আগের মতোই সব বোর্ডে পৃথক প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বর্তমানে দুটি সেট প্রশ্ন ছাপিয়ে একটি সেটে পরীক্ষা নেয়া হয়। বৈঠকে তিন থেকে চারটি সেট প্রশ্ন ছাপানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে স্বল্পসময়ের মধ্যে বিজি প্রেসে নতুন সেট ছাপানো সম্ভব নয়। সেনাবাহিনীর একটি প্রেসে বাড়তি সেট প্রশ্ন ছাপানোর চেষ্টা করবে মন্ত্রণালয়।

সূত্র আরো জানায়, এবারের এসএসসি পরীক্ষা শুরুর আধাঘণ্টা আগে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠেছিলো। এইচএসসি পরীক্ষায় সরকারি ট্রেজারি থেকে সব সেট প্রশ্ন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হবে। পরীক্ষা শুরুর ২০ মিনিট আগে বোর্ড থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বা কেন্দ্র সচিবকে জানিয়ে দেয়া হবে কোন সেট প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া হবে। বিজি প্রেস থেকে পরীক্ষার কেন্দ্র পর্যন্ত প্রশ্নের নিরাপত্তায় পরীক্ষার বিষয়ভিত্তিক আলাদা প্যাকেট করা হবে। প্যাকেটের ওপর বিশেষায়িত প্লাস্টিক লাগানো হবে (নিরাপত্তা ডিভাইস)। কেউ প্যাকেট খুললেই সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বার্তা যাবে। বৈঠকে উপস্থিত থাকা কর্মকর্তারা জানান, বোর্ডের চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিটি কেন্দ্রে একজন সৎ ও দক্ষ শিক্ষককে দায়িত্ব দেয়া হবে। তিনি পরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট বা প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন। এসব কর্মকর্তাকে পরীক্ষা শুরুর দুই ঘণ্টা আগে ট্রেজারি থেকে পরীক্ষার কেন্দ্রে প্রশ্ন নেয়া পর্যন্ত সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাদের নিরাপত্তায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বা একজন এসআইয়ের নেতৃত্বে পুলিশ থাকবে।

কর্মকর্তারা আরো জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্নফাঁসের গ্রুপ ও আইডিগুলো বন্ধ করতে ফেসবুকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এখন থেকেই যোগাযোগ করা হচ্ছে। যাতে অভিযোগ করলেই তাৎক্ষণিক লিংকগুলো বন্ধ করা যায়। আর প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে অর্থ লেনদেনের চিহ্নিত বিকাশ ও রকেটের মোবাইল নম্বরগুলোর প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে বন্ধ করে দেয়া হবে। অভিযুক্ত পরীক্ষা কেন্দ্রগুলো বাতিল করা হয়েছে। এবার সারা দেশে ২৪ হাজার ৬৭টি কেন্দ্রে ১২ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেবে।

২০০৮ সালের আগে বোর্ডভিত্তিক আলাদা প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া হতো। বিশ্বব্যাংকের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সারা দেশে অভিন্ন প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া হয়। সারা দেশের শিক্ষার্থীদের মেধার সঠিক মূল্যায়ন করতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনা তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের বর্তমান সচিব (তখন অতিরিক্ত সচিব) মো. সোহরাব হোসাইনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। কমিটির অন্যতম সুপারিশ ছিলো সব বোর্ডে আলাদা প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া। এর উদ্দেশ্য ছিলো এক বোর্ডের প্রশ্নফাঁস হলে অন্য বোর্ডের পরীক্ষা স্থগিত হবে না।

কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী প্রশ্নফাঁস রোধে ২০১৫ সাল থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা বোর্ডভিত্তিক আলাদা প্রশ্নপত্রে নেয়া হয়। তবে গত বছর শিক্ষাবিদরা সারা দেশের শিক্ষার্থীদের সমতার ভিত্তিতে মেধার সঠিক মূল্যায়ন করতে ফের অভিন্ন প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়ার সুপারিশ করেন। তাদের পরামর্শে সদ্যসমাপ্ত এসএসসি থেকে সব পাবলিক পরীক্ষা অভিন্ন প্রশ্নে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। এ সিদ্ধান্তটি সদ্যসমাপ্ত এসএসসি পরীক্ষায় বুমেরাং হয়। যে কারণে প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

সদ্যসমাপ্ত এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসকারীদের ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কারসহ নানা উদ্যোগ নিয়েও প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে ব্যর্থ হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রায় সব পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়। সমালোচনার ঝড় উঠে দেশজুড়ে। শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি ওঠে সংসদ ও রাজপথে।