বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল : ফাঁসছেন অনেকে

স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর বনানী এলাকার অভিজাত রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনা তদন্তে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। ফাঁস হয়ে পড়েছে ধর্ষক দুই তরুণের লাম্পট্য জীবনযাপনের নানা লোমহর্ষক কাহিনী। পুলিশের বেশ কজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে তাদের বিশেষ সখ্যের অজানা তথ্যও এরইমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। একই সাথে ধর্ষক শাফাত আহমেদের বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের ‘থলের কালো বিড়াল’ও বেরিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে তার রাতারাতি বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার দুর্ভেদ্য রহস্য।

এদিকে ধর্ষণের এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অনিয়ম-দুর্নীতি, শুল্ক-গোয়েন্দাদের নিষ্ক্রিয়তা এবং অসামাজিক কর্মকাণ্ডে থানা পুলিশের সহযোগিতার নানা চাঞ্চল্যকর তথ্যও ফাঁস হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি বিপুল অর্থবিত্তের দম্ভে দাম্ভিক দিলদারের নানা অপকর্মের সহায়তাকারী প্রভাবশালী দুই রাজনৈতিক নেতার মুখোশও এখন খুলতে শুরু করেছে।

দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনার তদন্তে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, ধর্ষক সাদমান সাকিফ ও শাফাত আহমেদকে রিমান্ডে নিয়ে তাদের লাম্পট্য জীবনযাত্রার যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা রীতিমতো বিস্ময়কর। নারীঘটিত এ ধরনের ঘটনাকে তারা তাদের আনন্দ-ফুর্তির অংশ হিসেবেই ধরে নিয়েছিলো। যা তারা নিঃসংকোচে গোয়েন্দাদের কাছে স্বীকারও করেছে। ধর্ষক এ চক্রের লালসার শিকার হয়ে আরও অনেকে সম্ভ্রম খুইয়েছে- এমন তথ্যও এখন তদন্তকারী দলের কাছে আসছে বলেও জানা গেছে। শাফাত ও সাদমান তাদের ‘ইনজয় নাইট’ গ্রুপের আরও ২১ সদস্যের নাম গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন। যাদের প্রায় সবাই বিভিন্ন শিল্পপতি ও খ্যাতানামা ব্যবসায়ীদের সন্তান। তাদের অনেকেই প্রেমের অভিনয় করে তরুণীদের ফুঁসলিয়ে হোটেলে নিয়ে দেহ ভোগ করাসহ নানা ধরনের অপকর্মের সাথে সম্পৃক্ত।

শাফাত গোয়েন্দাদের জানান, ঘটনার পর পুরো বিষয়টি ম্যানেজ করতে তারা একসাথে কাজ করলেও ধর্ষণের মামলার পর সবাই তাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে বলেও জানান তারা। এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলেও হোটেলের রুম বুকিং এবং ধর্ষণের সময় দুই তরুণীর আর্তচিৎকারকে তাদের আড্ডার অংশ হিসেবে উড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে রেইনট্রি হোটেলের পরিচালক মাহির হারুন ফেঁসে যাচ্ছেন বলে পুলিশের একজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন।

তবে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, তারা এখন শুধু হোটেল রেইনট্রিতে দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনার আনুষঙ্গিক ইস্যুগুলোতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। অন্যান্য বিষয়াদি আপাতত নথিবদ্ধ করে রাখছেন। প্রয়োজনে এসব ব্যাপারে পরে পৃথক মামলা করা হবে। এদিকে গত শনিবার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিদর্শক দল ধর্ষণের ঘটনাস্থল হোটেল রেইনট্রি পরিদর্শন শেষে সেখানে অবৈধ কিছু পাওয়া যায়নি বলে দাবি করলেও এর মাত্র একদিন পর শুল্ক গোয়েন্দারা হোটেল কক্ষে অভিযান চালিয়ে ১০ বোতল বিদেশি মদ উদ্ধারের পর মাদকের গুলশান জোনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কালো মুখোশ সবার সামনে খুলে পড়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, অভিজাত রেঁস্তোরা ও রেস্ট হাউজে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারাই যে অবৈধ মাদকব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে তার প্রমাণ এবার হাতেনাতে মিলে গেছে। এছাড়া এ ধরনের অপকর্মের পর মাদক কর্মকর্তারা বরাবরই যে দায়সারা জবাব দেন তার সত্যতাও প্রকাশ পেয়েছে।

অন্যদিকে দুই তরুণীর ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আকস্মিক শুল্ক গোয়েন্দাদের তৎপর হয়ে ওঠায় এ প্রশাসনের আসল ভূমিকা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছে। তাদের ভাষ্য, আপন জুয়েলার্স দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে একই স্টাইলে স্বর্ণ ব্যবসা চালিয়ে আসলেও শুল্ক গোয়েন্দারা এতদিন এ প্রতিষ্ঠানটিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছাড় দিয়ে এসেছে। এখন চারদিকে হৈচৈয়ের মুখে নিজেদের অপকর্ম ফাঁস হওয়ার ভয়ে শুল্ক গোয়েন্দারা নানামুখী তৎপরতা দেখাচ্ছেন। এছাড়া আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ব্যবসায়িক লেনদেনের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের চিঠি দেয়ার ঘটনাকে অনেকে ‘আইওয়াশ’ বলে মনে করছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, দিলদারের বিরুদ্ধে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে সোনা চোরাচালান, নকল ডায়মন্ড ও অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার অভিযোগ ওঠায় শুল্ক গোয়েন্দারা তাদের তৎপরতা দেখাচ্ছেন। তবে এ নিয়ে হৈচৈ থেমে গেলেই তারা আবার আগের ভূমিকায় ফিরে যাবে। তবে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মইনুল খান জানান, দিলদারের বিরুদ্ধে অস্বচ্ছ ব্যবসায়িক লেনদেনে জড়িত থাকার অভিযোগ আগে থেকেই ছিলো। এ কারণেই তার মালিকানাধীন আপন জুয়েলার্সের বিভিন্ন শোরুমের ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়া স্বচ্ছ আছে কি না, শুল্ক সঠিকভাবে পরিশোধ করছেন কি না- এসব তথ্য অনুসন্ধানে একজন উপপরিচালকের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি এত টাকার মালিক কীভাবে হলেন তা জানার চেষ্টা করা হবে। এদিকে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বলে মানবাধিকার কমিশনের তদন্তে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলেও রাজধানীর অভিজাত এলাকার বিপুলসংখ্যক রেস্ট হাউজ, হোটেল, গেস্ট হাউজে এ ধরনের কার্যক্রম এখনো চালু রয়েছে। বিষয়টি পুলিশের নজরে থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত মাসোহারা পাওয়ায় তারা পরোক্ষভাবে এতে মদদ দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, শুধুমাত্র গুলশান, বনানী ও উত্তরা এলাকাতেই শতাধিক আবাসিক হোটেল, গেস্ট হাউজ ও রেস্ট হাউজ রয়ে। সেখানে তরুণ-তরুণীদের রুমডেটিং করার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। অথচ হোটেল কক্ষ ভাড়া দেয়ার আগে প্রতিটি বোর্ডারের বায়োডাটা সংগ্রহ এবং তাদের ছবি তুলে রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নিকটাত্মীয়স্বজন হলেও অবিবাহিত তরুণ-তরুণীকে একত্রে রুম দেয়ার ক্ষেত্রেও ঢাকা মহানগর পুলিশ সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। অথচ এসব নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে থানা পুলিশের প্রত্যক্ষ মদদে আবাসিক হোটেলগুলো প্রতিনিয়ত সন্দেহভাজন তরুণ-তরুণীদের রুম ভাড়া দিচ্ছে। এ সুযোগ আবাসিক হোটেলগুলো এখন ধর্ষক, খুনি, চাঁদাবাজ ও বস্ন্যাকমেইলারদের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়েছে। দুষ্কৃতকারীদের আরেক অংশ মিথ্যা প্রেমের অভিনয় করে, বিয়ে-চাকরি ইত্যাদির প্রলোভন দেখিয়ে তরুণীদের হোটেলে নিয়ে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে। এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটলেও সবই পুলিশকে ম্যানেজ করে চলছে। তদন্তে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দাদের ধারণা, হয়তো এ কারণেই বনানী থানার ওসি হোটেল রেইনট্রিতে দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় মামলা নিতে চাননি। বরং তারা যাতে এ নিয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষকে বিপাকে ফেলতে না পারেন এ জন্য ধর্ষিতা ওই দুই তরুণী থানায় মামলা করতে গেলে তাদের উল্টো ধমক দিয়ে থানা থেকে বের করে দিয়েছেন।

ধর্ষণের ঘটনার তদন্ত টিমের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ধর্ষণের ঘটনায় বনানী থানায় মামলা হওয়ার আগে ও পরে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের পক্ষে ক্ষমতাসীন দলের দুই নেতা জোরালো তদবির করেন। এমনকি ধর্ষক শাফাত-সাদমান গ্রেফতার হওয়ার পরও তাদের সে অপতৎরতা অব্যাহত ছিলো। তবে এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের সাথে কথা বলার পর তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। ওই দুনেতা দিলদার আহমেদের অনেক অপকর্মের সহায়তাকারী বলেও জানান ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্র থেকে দিলদারের শেল্টারদাতা দুই নেতাকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। দলের ইমেজ রক্ষার্থে ভবিষ্যতে তারা আর এ ধরনের অপতৎপরতা থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার করেছেন।